বাংলাদেশের এগিয়ে চলা

কোন মহামানবই এক জীবনে সব কাজ শেষ করতে পারেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও পারেননি। মহামতি লেনিন, মহাত্মা গান্ধী কিংবা হোচিমিন কেউ পারেননি তাদের স্বপ্নের সবটুকু বাস্তবায়ন করতে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শাসনভার হাতে নিতে না নিতেই পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ নুরুল ইসলামকে বললেন, ‘আমার স্বাভাবিক মৃত্যু হবে না।’ এম আর আক্তার মুকুল লন্ডনে যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলছিলেন, ‘আমার জামা খুলে দেখ তো এই বুকে কয়টি গুলি বিদ্ধ হবে।’ চিলির প্রেসিডেন্ট ড. আলেন্দের মৃত্যুর পর তিনি বক্তৃতায় প্রায়ই বলতেন, ‘আমার অবস্থা যদি চিলির আলেন্দের মতোও হয়, তবুও আমি সমাজতান্ত্রিক চিন্তা থেকে পিছ পা হবো না।’ জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে ড. ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে বলেছিলেন, ‘যা হয় হবে পিছ পা হবো না।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে গোটা বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতি চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ম্যান্ডেট, বাংলাদেশের সংবিধান, জাতীয় স্লোগান, সংবিধানে স্থানপ্রাপ্ত জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রীয় দর্শন পরিবর্তন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় আদর্শকে পেছনমুখী করে হটিয়ে দেয়া হয়েছিল। চিন্তা-চেতনার বিশৃঙ্খলা দিয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা করা যায় না। পন্ডিত জওহর লাল নেহরুর ‘আত্মচরিত’ পাঠ করলে বোঝা যায়, সেকুলার চিন্তার অধিকারী ছিলেন তিনি। তিনিই ভারতের আধুনিক নির্মাতা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোকের পর্বত মাথায় নিয়ে যখন বাংলাদেশে পদার্পণ করেন, তখন আওয়ামী লীগ দুর্নামে আকণ্ঠ ডুবন্ত। ততদিনে আওয়ামী লীগকে ইসলামের শত্রু, ভারতের দালাল, বাকশাল, রক্ষীবাহিনী ও ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের অপযশ দিয়ে কোণঠাসা করে ফেলেছে। তখন দুটোদিক সবলে খাড়া হয়ে উঠেছেÑ মুক্তিযুদ্ধের বৈরী চেতনা ও সাম্প্রদায়িকতা। তখন বাংলাদেশে ১৯৭২-এর সাংবিধানিক শত্রুপক্ষ ও অপশক্তি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। শুরু হয়েছে জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বভিত্তিক পশ্চাদমুখী রাজনীতি। এই অবস্থায় ধসে পড়া দলের কান্ডারি হলেন শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক পুঁজি শুধুই বঙ্গবন্ধুর কন্যা।

আজ তিনি অং সান সুচির চেয়েও, এমন কি সোনিয়া গান্ধীর চেয়েও অনেকাংশে সফল। তিনি রাজনীতিতে ‘স্ট্রাগল ফর এক্সিস্টেন্স’ কথাটি প্রমাণ করেছেন। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে, বঙ্গবন্ধুর দোহাই দিতে দিতে নিজস্ব রাজনৈতিক পথ নির্মাণ করেছেন, রাজনীতির কৌশল রপ্ত করেছেন, প্রতিপক্ষ মোকাবেলার পথঘাট নখদর্পণে এনেছেন। ১৯৯৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত শুধু পরাজিতই হয়েছেন। ২০০১ সালে ভূমিধস পরাজিত হয়েছেন। এ পর্যন্ত ২০ বার মৃত্যুর মুখোমুখি ও আক্রমণের শিকার হয়েছেন। বিশিষ্ট কলাম লেখক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী তার এক কলামে তারিখগুলো উল্লেখ করেছেন, কোন কোন তারিখে শেখ হাসিনা মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। (স্বদেশ খবর- ২/০৫/২০১৫, পৃ. ২৯)। তার মাথার ওপর এখনও অসংখ্য, অমার্জিত হুমকি অব্যাহত আছে।

এসব বিঘœসঙ্কুল প্রতিবন্ধকতাময় পরিস্থিতি মোকাবেলা করে তিনি বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ধরে রেখেছেন। এমন কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয় যে, এখন বাংলাদেশে আর কোন সমস্যা নেই। সমস্যা নিয়ে এখনও মহাভারত রচনা করা যাবে হয়ত; তবু এর মধ্যেই মেরুদ- সোজা করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

শেখ হাসিনার কৃতিত্ব শনাক্ত করা জাতীয় স্বার্থেই প্রয়োজন। শেখ হাসিনা বাস্তব কারণেই কিছু স্ববিরোধিতা অপনোদন করতে পারেননি। ১৯৭২-এর সংবিধান এখনও ১৯৭২ সালের জায়গায় নিয়ে যেতে পারেননি। তার প্রধান প্রতিপক্ষ সাম্প্রদায়িক শক্তি, তার প্রধান মিত্র দলটিও সাম্প্রদায়িক দর্শনে বিশ্বাসী (জাপা)। কী সাংঘাতিক ত্রিশঙ্কু দশা! এর মধ্যেও মনীষী মওলানা আবুল কালাম আজাদের কথাটি তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন, ‘ধর্ম ব্যক্তির রাষ্ট্র সকলের।’ তিনি ব্যক্তিগতভাবে রোজা-নামাজ করেন কিন্তু রাজনীতির মঞ্চে বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন করার কথা। এটাই শেখ হাসিনার চারিত্রিক মটো। তিনি কখনও রাজনীতির মঞ্চে ধর্ম আর ধর্মের মঞ্চে রাজনীতি টেনে আনেন না।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশংসার ঢেউয়ে রাস্তায় নামতে পারি না। যারা অতীতে ভারতবিদ্বেষী রাজনীতি করেছেন, মোদির প্রশংসার মদিরা তাদের গ্লাস থেকেই উপচে পড়েছে। ভারতের দালাল আখ্যা শেখ হাসিনা কম পাননি। তিনি নাকি ‘প্রভু দেশের’ রাজনীতি করতেন। সেøাগান উঠেছিল, ‘ভারত যাদের মামাবাড়ি, বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি।’ প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখা ও তার অবদান অকপটে স্বীকার করার উপকারিতা আজ হাতে-নাতে দিয়ে দিলেন শেখ হাসিনা। ছিটমহল চুক্তির সাফল্য বঙ্গবন্ধু দেখে যেতে পারেননি। শেখ হাসিনা কূটনৈতিক সাফল্য দিয়ে তা অর্জন করলেন। এটা ভারতবিরোধী রাজনীতির ফসল নয়, সুপ্রতিবেশী সুলভ স্বচ্ছ রাজনীতির ফসল। কূটনৈতিক যুদ্ধে শেখ হাসিনা প্রথমে মিয়ানমার তারপর ভারতকে হারিয়ে সমুদ্র জয় করেছেন।

এ কলামে কোন যান্ত্রিক পরিসংখ্যান দিয়ে লেখাটা ভারাক্রান্ত করতে চাই না। একটি অনলাইন পত্রিকা জানাচ্ছে, মাথাপিছু অর্থনৈতিক আয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ধনী ভারত। এছাড়া প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের ব্যবহারের দিক থেকেও এগিয়ে ভারত। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট বেশকিছু সূচক রয়েছে, যাতে ভারতের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। যেমন মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যু হার রোধ, শিশুমৃত্যুহার কমিয়ে আনা এবং মাধ্যমিক শিক্ষায় ছেলের অনুপাতে মেয়েদের অংশগ্রহণ। এসব দিক থেকে ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।

আরও বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবায় দু’দেশই জিডিপির ১ শতাংশ ব্যয় করে। তবে শিক্ষায় বাংলাদেশ জিডিপির ২ শতাংশ ব্যয় করলেও, ভারত করে ৩ শতাংশ। জাতিসংঘের নারীবিষয়ক কান্ট্রি প্রতিনিধি ক্রিসেন্ট হান্টার বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য লিঙ্গ সমতা অত্যন্ত গুরুত্বপর্ণ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও শিক্ষায় মেয়েদের এগিয়ে আসায় তা নারীর ক্ষমতায়নেও দেশকে এগিয়ে দিচ্ছে। আইএলওর হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সালে বাংলাদেশে বেতনভুক্ত নারী শ্রমিক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ শতাংশ। বাংলাদেশে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দীর্ঘ ৯৫ দিন এবং তার আগেও হরতাল অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির বোঝা মাথায় নিয়েও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

লেখক : মাহমুদুল বাসার
কলাম লেখক ও গবেষক