স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যত অর্জন আছে, তার মধ্যে কৃষিতে অর্জন আজ উল্লেখ করার মতো। একদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে সঙ্গে দিন দিন কমছে আবাদযোগ্য জমি। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টা উৎপাদনে বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। আর তা সম্ভব হয়েছে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের নীতি ও বিনিয়োগের কারণে। শাক-সবজি ও ফলমূলের সঙ্গে সাম্প্রতিককালে আলু রপ্তানি বাংলাদেশের কৃষির উল্লেখযোগ্য সাফল্য। বর্তমানে যে উৎপাদন তা দেশের চাহিদা মিটিয়েও রপ্তানি করা হচ্ছে।
কয়েকদিন আগে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার মথুরাপুর গ্রামে গিয়েছিলাম। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার কারণে স্বভাবগত কারণে কৃষকদের সঙ্গে আমার কথা বলা কিংবা সেখানকার কৃষির অবস্থা দেখা এক প্রকার নেশা। দেখলাম সেখানকার কৃষকরা কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। কৃষি ব্যাংকের শাখাগুলো কৃষকদের ফসলের ওপর সরাসরি ঋণ বিতরণ করার কারণে কৃষকরা সহজেই কৃষির উপকরণ সংগ্রহ করতে পারছে। বিশেষ করে ট্রাক্টর, ধান মাড়াই করার কল, ধান রোপণের আধুনিক যন্ত্রপাতির ওপর বিশেষ ঋণ কার্যক্রম গ্রহণ করার কারণে অনেক কৃষকই এখন কৃষিতে ভালো করছে। তবে কৃষি ঋণের সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো ঋণ হলো তেল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন এবং ডাল উৎপাদনে মাত্র শতকরা ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ায় কৃষকরা অনেক সহজেই আমদানিমুখিতাকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর তত্ত্বাবধানে স্বল্প সুদে ঋণ কার্যক্রম গ্রহণ করার কারণে পেঁয়াজ, রসুন, ডাল এবং তেল আমদানির বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিশেষ সুবিধার আওতায় এনে কৃষকদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার নির্দেশনা জারি করেছে। এ নির্দেশনার ফলে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকরা গ্রামের মাঠে মাঠে সরাসরি কৃষকদের ব্যাংকের ফরম বিতরণ করে কৃষকদের ঋণ দিচ্ছে। এতে একটা সুবিধা হলো কোনো কৃষককেই তাই দালালদের মাধ্যমে কমিশন দিয়ে টাকা উত্তোলন করতে হচ্ছে না। এটা ঋণ বিতরণে কৃষকদের জন্য একটা মাইলফলক। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি সব সরকারি, আধা সরকারি এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারত তাহলে দেশের উৎপাদন হতো আকাশচুম্বী। কোনো দেশ থেকেই আমদানি করে খাদ্যশস্য আনতে হতো না।
বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষুষ্ণ শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। স্বাধীনতার পর দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে ধান উৎপাদিত হতো দুই টন। আর এখন উৎপাদন হচ্ছে হেক্টর প্রতি চার টনেরও বেশি। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের মোট ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। বর্তমান সরকারের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ এবং দেশের পরিশ্রমী কৃষক ও মেধাবী কৃষিবিজ্ঞানীদের যৌথ প্রয়াসেই এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। গত পাঁচ বছরে দেশের মানুষকে খাওয়ানোর জন্য বাংলাদেশ কোনো চাল আমদানি করেনি। বরং বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কায় চাল রপ্তানি শুরু করেছে।
বাংলাদেশে এখন খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির সবদিক থেকে বিশ্বের জন্য পথিকৃৎ। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ৬৭ টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উদ্ভাবন করেছে ১৪টি ধানের জাত। আর ১১৫টি হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলো। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) এর বিজ্ঞানীরা মোট ১৩টি প্রতিক‚ল পরিবেশ সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে লবণ সহিষ্ণু ৯টি, খরা সহিষ্ণু ২টি ও বন্যা সহিষ্ণু ৪টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন তারা। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) এ পর্যন্ত ২৬টি জাত অবমুক্ত করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) বেশ কয়েকটি জাত ছাড়াও এরই মধ্যে পাটের জীবন রহস্য উন্মোচন করেছে। গত পাঁচ বছরে তারা ছয়টি জাত অবমুক্ত করেছে। আরো দুটি জাত অবমুক্তের অপেক্ষায় রয়েছে। গত বছর বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এতগুলো প্রতিক‚ল পরিবেশ সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ। হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ আর মোট ধান উৎপাদনে বঙ্গবন্ধুর বাংলদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ।
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার হিসেব মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। গত এক যুগে দেশে রীতিমতো সবজি বিপ্লব ঘটে গেছে। এখন দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। এসব সবজির ৯০ শতাংশ বীজই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে। এ কৃষক পরিবারগুলোর প্রায় সবাই কমবেশি সবজি চাষ করেন। গত এক যুগে দেশে মাথাপিছু সবজির ভোগ বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। পাশাপাশি সবজি রপ্তানি করেও মিলছে বৈদেশিক মুদ্রা। গত এক বছরে শুধু সবজি রপ্তানি আয় বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হারে সবজির আবাদির জমির পরিমাণ বেড়েছে বাংলাদেশে, বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসেবে ২০ বছর আগে ১৯৯৪ সালে দেশে মাথাপিছু দৈনিক সবজি খাওয়া বা ভোগের পরিমাণ ছিল ৪২ গ্রাম। বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) হিসেবে ২০১৪ সালে দেশে মাথাপিছু সবজি ভোগের পরিমাণ ৭০ গ্রাম।
প্রাচীন ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ কথাটি মাঝে হারিয়ে গেলেও বর্তমানে তা আবারো বাস্তব। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদন মতে ২০১৪ সালে মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। মাছ উৎপাদনে চীন বিশ্বসেরা, ২য় ও ৩য় অবস্থানে আছে যথাক্রমে ভারত ও মায়ানমার। তারপরই বাংলাদেশের অবস্থান। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অর্থনৈতিক শুমারি বলছে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৩৪ লাখ ৫৫ হাজার টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে তন্মধ্যে চাষ করা মাছের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ লাখ টন। জাটকা সংরক্ষণসহ নানা উদ্যোগের ফলে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ৫২ হাজার টন বেড়ে সাড়ে তিন লাখ টন হয়েছে। মাছ রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে ১৩৫ গুণ। বাংলাদেশের হিমায়িত মৎস্য রপ্তানির পরিমাণ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেড়ে চার হাজার ১৪৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বে মোট আম উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। আর বাংলাদেশের অবস্থান নবম। কৃষি ও খাদ্য সংস্থার সর্বশেষ মূল্যায়নে প্রতিবেদিত হয়েছে যে প্রায় সাড়ে নয় লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৮ লাখ ৪২ হাজার আর ২০১০-১১ তে ৮ লাখ ৮৯ হাজার টন। ২০১১-১২ অর্থবছরে তা আরো বেড়ে যায় প্রায় সাড়ে নয় লাখ টনে। দেশে গড়ে ৩২ হাজার একর জমিতে আমের আবাদ হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের ল্যাংড়া ও আম্রপালি আম। বাংলাদেশ থেকে আম রপ্তানির ব্যাপারে বিশ্বের শীর্ষ পণ্য ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল প্রকিউরমেন্ট লজিস্টিকসের সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন ও এফএওর মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে।
এক দশক আগেও বাংলাদেশের আলু উৎপাদন ছিল অর্ধলাখ টনের নিচে। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে বর্তমানে বাংলাদেশে আলুর উৎপাদন ৮২ লাখ ১০ হাজার টন। এ সাফল্য বাংলাদেশকে করেছে আলু উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম। অচিরেই বাংলাদেশের আলু উৎপাদন কোটি টনের দিকে যাবে বলে আশা করা যায়। উৎপাদন বিস্ময়কর সাফল্যই কেবল নয়, আলু এখন দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসলও। গত বছর রাশিয়ায় প্রায় ২৫ হাজার টন আলু রপ্তানি হয়েছে। ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে আলু আমদানির আগ্রহ দেখিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। অথচ এর আগে বিশ্বের ২০টি দেশ থেকে বাংলাদেশকে আলু আমদানি করতে হতো।
এ সব সাফল্যের ফলে বাংলাদেশের কৃষিতে উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মাননাপত্র দিয়ে সম্মান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সফরকারী পরিচালক রোনি কোফিম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের পক্ষে ২০ মে ২০১৫ সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করে সম্মাননাপত্রটি হস্তান্তর করেন। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড্যাভিড জে স্কোরটন স্বাক্ষরিত সম্মাননাপত্রে বাংলাদেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে, খাদ্য উৎপাদনে স্বাবলম্বিতা অর্জনে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদানকে সমর্থন জানানো হয়।
বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে বর্তমান সরকারের সুপরিকল্পিত কৃষিনীতির আলোকে দেশের কৃষি শিক্ষা, গবেষণা ও সম্পসারণ প্রতিষ্ঠানসমূহে কর্মরত দক্ষ ও যোগ্য কৃষিবিদদের কল্যাণে এবং দেশের কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই অর্জিত হয়েছে এ সাফল্য। এ সাফল্য ধরে রাখতে সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। সে সঙ্গে দেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ধরে রাখবে।
প্রফেসর ড. মো. সেকেন্দার আলী : অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।