বড় স্বপ্নের বড় বাজেট


 

** সংসদে ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব ** রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা ** জিডিপির লক্ষ্য ৭ শতাংশ ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ৬.২ শতাংশ *

টুটুল রহমান : বড় স্বপ্ন সামনে রেখে বিশাল আকারের বাজেট দিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আগামীর পথে অগ্রযাত্রা আর উচ্চ প্রবৃদ্ধি পথ রচনার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন তিনি। এতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশ নির্ধারণ করে ২০২১ সালের আগেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্নের কথা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন ৬ দশমিক ২ শতাংশ। তার প্রত্যাশা, ২০১৮ সালের মধ্যে মানবসম্পদ উন্নয়ন, মাথাপিছু আয় ও অর্থনীতির ঝুঁকিগ্রস্ততা সূচকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে বাংলাদেশ এবং খুলে যাবে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দ্বার। প্রথমবারের মতো শিশু বাজেট দেয়া হয়েছে, যা স্বপ্নের মতোই। কর বাড়াতে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। এ লক্ষ্যে প্রতিটি জেলায় কর অফিস করা হচ্ছে।

ব্যক্তি আয়করমুক্ত সীমা ২ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ন্যূনতম কর তিন হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪ হাজার টাকা। এ ছাড়াও কর্পোরেট কর ৪২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়েছে।

বিড়ি ও কম দামি সিগারেটে সামান্য কর বাড়ানো হয়েছে। তবে ধোঁয়াবিহীন তামাকে করারোপের কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। দামি সিগারটে করহার প্রায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এবারের বাজেটে প্রথমবারের মতো সিগারেটের সর্বনিম্ন মূল্য বেঁধে দিয়ে তার ওপর একটি সম্পূরক শুল্ক ও মূসক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতি দশ (১০) শলাকা সিগারেটের সর্বনিম্ন ভিত্তিমূল্য প্রস্তাব করা হয়েছে ১৯ টাকা এবং এর ওপর সম্পূরক শুল্ক ধার্য করা হয়েছে ৪৮ শতাংশ।

স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অগ্রযাত্রার পথ রচনায় প্রস্তাবিত বাজেটের আকার হচ্ছে ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৭ দশমিক ২ শতাংশ। বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের এটা দ্বিতীয় বাজেট। গত অর্থবছরে (২০১৪-১৫) বাজেটের আকার ছিল দু?ই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। এবারের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের এ প্রস্তাবিত বাজেট বক্তব্য শুরু করেন। একই সঙ্গে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট ও অর্থ বিল ২০১৫ সংসদে উপস্থাপন করেন তিনি।

এ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা আদায় করা হবে। এনবিআর বহির্ভূত সূত্র থেকে কর রাজস্ব প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া কর বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ২৬ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা।

প্রস্তাবিত বাজেটে ন্যূনতম আয়কর তিন হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে চার হাজার টাকা করা হয়েছে, সে সঙ্গে ব্যক্তি আয়করমুক্ত সীমা ২ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রস্তাবিত বাজেটে কর ও ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হয়েছে।

সামাজিক নিরাপত্তা ও ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি), পদ্মা সেতু, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়ন খাতেও বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া শিশুদের জন্য প্রথমবারের মতো ঘোষণা করা হয়েছে ‘পৃথক শিশু বাজেট’। ছিটমহলবাসীদের জন্য রাখা হয়েছে বিশেষ বরাদ্দ।

এবারের বাজেট ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৪৪ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা বেশি। গত অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ শতাংশ। যা গতবার ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।

বাজেটের ঘাটতি পূরণ করা হবে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র এবং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান থেকে। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ বাবদ ৩২ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা (গত অর্থবছরে এ খাতে ছিল ২৬ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা), বৈদেশিক অনুদান বাবদ ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা (গত অর্থবছরে এ খাতে ছিল ৬ হাজার ২০৬ কোটি টাকা), ব্যাংকিং খাত থেকে ৩৮ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা (গত অর্থবছরে এ খাতে ছিল ৩১ হাজার ২২১ কোটি টাকা) ও ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা (গত অর্থবছরে এ খাতে ছিল ১২ হাজার ৫৬ কোটি টাকা) নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। ব্যাংক বহির্ভূত খাতের মধ্যে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা (গত অর্থবছরে এ খাতে ছিল ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা) ও অন্যান্য খাত থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা (গত অর্থবছরে এ খাতে ছিল ৩ হাজার কোটি টাকা) নেয়া হবে।

এই বিশাল ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশই রাজস্ব খাত থেকে আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে জনগণের ওপর করের বোঝা না বাড়ানোর কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি জরিপ করে পাওয়া নতুন ৫ লাখ করদাতাকে করজালে এনে রাজস্ব বাড়ানোর কথা তুলে ধরেছেন। শেখ হাসিনার সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে এর আগে ছয়বার বাজেট দিয়েছেন তিনি। আর ব্যক্তিগতভাবে এটা হতে যাচ্ছে তার নবম বাজেট।

বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক অগ্রগতি তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তব্যে বলেন, ২০০৯-১৪ সময়ে বৈশ্বিক অর্থনীতির গতি ছিল মন্থর। ২০০১-০৬ বছরে ছিল বিশ্ব প্রবৃদ্ধির অনন্য সময়। ২০০৯-১৪ মেয়াদে আমাদের অর্থনীতির বিকাশের ধারা প্রশংসনীয়। এ পাঁচ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ হারে। সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির হার ৫ দশকি ৬ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে ৩ গুণ, মাথাপিছু আয় বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। রাজস্ব জিডিপির অনুপাত ৮ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ১০ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, বাজেটের আকার বেড়েছে ৪ গুণ, উন্নয়ন কার্যক্রম বেড়েছে ৩ গুণ, চালের উৎপাদন বেড়েছে ৩৭ শতাংশ, আমদানি, রপ্তানি ও প্রবাস আয় প্রতিটি বেড়েছে ৩ গুণ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে ৬ গুণের বেশি।

আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিণত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৮তম।