বর্তমান সরকারের চলতি (জানুয়ারি ২০১৪ থেকে মে ২০১৫) মেয়াদে ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। এর মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ২টি এবং বেসরকারি ৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে ১ হাজার ১শ’ ২৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। জ্বালানি তেল ব্যবহার করে উৎপাদন হচ্ছে ৬১৮ মেগাওয়াট আর গ্যাস ব্যবহার করে ৫১১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের আগে সাশ্রয়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প উৎপাদনে আসার সম্ভাবনা নেই। তাই বিদ্যুৎ খাত তেলের ওপর নির্ভরশীল থাকবে আরও তিন বছর।
তেলের ব্যবহার কমাতে সাশ্রয়ী কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের সরকারি বেসারকরি কোন উদ্যোগ এখনও আলোর মুখ দেখেনি। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৮ সাল থেকে বাস্তাবায়নাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো একে একে উৎপাদনে আসা শুরু করবে। এর মধ্যে সরকারি উদ্যোগে পিডিবির বড়পুকুরিয়া ২৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে ২০১৮ সালের মার্চে, আমদানিকৃত কয়লা থেকে বেসরকারি উদ্যোগে ওরিয়ন গ্রুপের মুন্সীগঞ্জ মাওয়া ৫২২ মেগাওয়াট এবং খুলনা ৫৬৫ মেগাওয়াট উৎপাদনে আসবে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে। তিনি জানান, বর্তমানে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ২ দশমিক ১৭ শতাংশ আসে কয়লা থেকে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদা দাঁড়াবে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। এই বিশাল চাহিদার জোগান দিতে ব্যয়বহুল জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে আরও তিন বছর।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ থেকে ৮ মে ২০১৫ পর্যন্ত ১ হাজার ১শ’ ২৯ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মোট ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। এর মধ্যে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কো. লি. (এপিএসসিএল) এর একটি এবং নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কো. লি. এর একটি ছাড়া
বাকি ৯টি বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত। উৎপাদনে আসা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে গ্যাসভিত্তিক ৪শ’ ৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩টি, তেলভিত্তিক ৩শ’ ৬৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৫টি এবং মিশ্র-জ্বালানিভিত্তিক (গ্যাস ও তেল) ৩শ’ ২৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। মিশ্র-জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে ১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস ব্যবহার করে ৬৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। বাকি দুটো চলছে তেলে। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, সরকারের চলতি মেয়াদে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়া ১ হাজার ১শ’ ২৯ মেগাওয়াট বিদ্যুতের মধ্যে জ্বালানি তেল ব্যবহার করে ৬শ’ ১৮ মেগাওয়াট আর গ্যাস ব্যবহার করে ৫১১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেলভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্রাতিরিক্ত উৎপাদন খরচের কারণে বিদ্যুৎ খাতে আকাশচুম্বি ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নতুন তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের ওপর জোর দিতে হবে। এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সরকারের আরও বেশি নজর দিতে হবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সম্প্রতি বিদ্যুৎ ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভবিষ্যতের তেলের ব্যবহার কমিয়ে মিশ্র জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে সাশ্রয়ী কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে রামপাল, মাতারবাড়িতে স্থাপিতব্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পর্যায়ক্রমে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এছাড়া, সৌর বিদ্যুত এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, গত প্রায় দেড় বছরে উৎপাদনে আসা ৫টি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে : নাটোরে রাজ-লঙ্কা পাওয়ার লি. এর ৫২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বরকতউল্লাহ ডায়নামিক এর ৫০ মেগাওয়াট, পটিয়ায় ইসিপিভি চিটাগাং লি. এর ১০৮ মেগাওয়াট, গগনগরে ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের ১০২ মেগাওয়াট, মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টিতে সিনহা পিপলস এনার্জি লি. এর ৫০ মেগাওয়াট। দেড় বছরে উৎপাদনে আসা ৩টি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো হলো : ঘোড়াশালে রিজেন্ট এনর্জি অ্যান্ড পাওয়ার লি. এর ১০৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, আশুগঞ্জে এপিএসসিএলের ২২৫ মেগাওয়াট এবং ইউনাইটেড পাওয়ারের ১৯৫ মেগাওয়াট মডুলার বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ সময় উৎপাদনে আসা মিশ্র-জ্বালানিভিত্তিক ৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে দুটিতে তেল ব্যবহার করে উৎপাদন চালু হয়েছে। কেন্দ্র দুটি হলো : নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে সামিট পাওয়ারের মেঘনাঘাট ২০৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং কুমিল্লার জাঙ্গালিয়ায় লাকধানবি বাংলা পাওয়ার লি. এর ৫২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। গ্যাস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে সিরাজগঞ্জে এনডবিস্নউপিজিসিএলের ৬৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র।
পিডিবির গত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দৈনিক চাহিদার বিপরীতে দেশে প্রতিদিন গড়ে (কমবেশি) ১৩০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন কিলোওয়াট আওয়ার (মিলিয়ন ইউনিট) বিদ্যুৎ (আমদানিসহ) উৎপাদন করা হচ্ছে। এর মধ্যে গ্যাস থেকে আসছে ১০০ থেকে ১০৭ মিলিয়ন ইউনিট আর তেল থেকে ২৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন ইউনিট, কয়লা থেকে সাড়ে ৩, জলবিদ্যুৎ থেকে প্রায় এক মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এছাড়া ভারত থেকে (কমবেশি) ১১ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ আসছে। পিডিবির তথ্যে দেখা গেছে, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে যেখানে ৭ কোটি টাকা মূল্যের গ্যাসে ১০৭ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ৪০ কোটি টাকার তেল পুড়িয়ে মাত্র ৩০ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।
দেশে বিদ্যুতের বর্তমান স্থাপিত ক্ষমতা ১১ হাজার ৪০৮ মগোওয়াট। উৎপাদনে রয়েছে ৯১ টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে গত ০৬ মে ৭ হাজার ৭১২ মেগাওয়াট। উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে গ্যাসে ৬৭ দশমকি ১ শতাংশ, তেলে সাড়ে ২৪ শতাংশ, কয়লা থেকে ২ দশমিক ১৭ শতাংশ, হাইড্রো ২ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় এবং ভারত থেকে আসে (কমবেশি) সোয়া ৪ শতাংশ। গ্যাস স্বল্পতার কারণে প্রতিদিন প্রায় ৫শ’ মেগাওয়াট এবং যান্ত্রিক ত্রুটির (বন্ধ বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ) কারণে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। দেশে তেলের কোন সংকট না থাকায় পুরোদমে চলছে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।
উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৭০ শতাংশ (নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ) জনগোষ্ঠী বিদ্যুতের সুবিধা পাচ্ছে। মোট গ্রাহক সংখ্যা এক কোটি ৬৭ লাখ। ২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে বিদ্যুৎ পেঁৗছে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর উৎপাদনে এসেছে পাঁচ হাজার ৬৩৭ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ৭০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র।