ঘুরে দাঁড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা

মুহাম্মদ রুহুল আমিন : আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ২০০৯ সাল থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে নানা সমস্যায় জর্জরিত নগরবাসীর পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের সেবা প্রদানকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসা। নগরবাসীর দৈনন্দিন পানির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব আয়। পানি উৎপাদনে ভূ-গর্ভস্থের ওপর চাপ কমাতে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে ৩টি মেগা প্রজেক্ট। বেড়েছে বিদেশি ইনভেস্টমেন্টও। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির সিস্টেম লস ৪০ ভাগ থেকে কমে বর্তমানে নেমে এসেছে ২২ ভাগে। বৈধভাবে পানি সংযোগের আওতায় আনা হচ্ছে বস্তিবাসীদেরও। পানির বিল পরিশোধ ও গ্রাহকদের হয়রানি কমাতে ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতি।

ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, মাত্র ৩০টি নলক‚প নিয়ে ১৯৬৩ সালে সাড়ে ৮ লাখ লোকসংখ্যা নিয়ে ঢাকায় পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন সেবার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে ঢাকা ওয়াসা। ৫১ বছর পেরিয়ে বর্তমানে ঢাকা ওয়াসা পরিণত হয়েছে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে প্রতিদিন ১ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি মানুষের পানির চাহিদা মেটাচ্ছে সংস্থাটি। পানি সরবরাহ, ড্রেনেজ সিস্টেম, স্যুয়ারেজ সিস্টেম ছাড়াও জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক অপরিহার্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। নানা সীমাবদ্ধতা ও অনিয়ম-দুর্নীতি থাকলেও বিপুলসংখ্যক মানুষের চাহিদা পূরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে ওয়াসা।

মেগাসিটি ঢাকার বিপুলসংখ্যক মানুষকে পানি সরবরাহ করার মতো বিশাল চ্যালেঞ্জে ঢাকা ওয়াসা সব সময়ই জয়ী হয়েছে। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে সায়েদাবাদে উদ্বোধন করা হয়েছে দৈনিক সাড়ে ২২ কোটি লিটার উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার-২ প্রকল্প। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার রয়েছে ৬৫১টি গভীর নলক‚প। রয়েছে চারটি পানি শোধনাগার প্রকল্প। দৈনিক ২২৪ কোটি লিটার চাহিদার বিরপীতে পানি উৎপাদন ক্ষমতা ২৪২ কোটি লিটার। ৩ লাখ ২৬ হাজার ৬০০ বস্তিবাসীও ওয়াসার সেবার আওতায় এসেছে। এ ছাড়া রয়েছে ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট, ২৯৫ কিলোমিটার ড্রেনেজ লাইন ও ৮৮২ কিলোমিটার পয়ঃনিষ্কাশন লাইন।

ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, ভূ-গর্ভস্থ পানি উৎপাদন থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে সার্ফেস ওয়াটার প্ল্যান ট্রিটমেন্টের জন্য সায়েদাবাদ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান ফেইস-৩, পদ্মা জশলদিয়া ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যানসহ ৩টি মেগা প্রজেক্ট গ্রহণ করেছে সংস্থাটি। এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থানা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান ভোরের কাগজকে বলেন, ভূ-গর্ভস্থ পানি উৎপাদন থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে গৃহীত প্রকল্প তিনটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা ঢাকা ওয়াসাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাবলিক সেক্টরে ওয়াটার ইনটোনেটিভ হিসেবে পরিগণিত করব। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ভিশন-২০২১ বাস্তায়নের লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি। কিন্তু এখন আমরা আশাবাদী যেভাবে কাজ হচ্ছে তাতে করে ২০২০ সালেই আমরা পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও গণমুখী পানি ব্যবস্থাপনা চালু করতে পারব।

কেবল সাধারণ পানির ক্ষেত্রেই নয়, বিশুদ্ধ বোতলজাত মিনারেল পানি সরবরাহের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই ঢাকা ওয়াসা। প্রায় এক যুগ ধরে চলছে বোতলজাত ‘শান্তি’ পানি সরবরাহের কার্যক্রম। মিরপুরে ‘শান্তি’র প্ল্যান্ট থেকে যে বোতলজাত পানি বাজারজাত করা হচ্ছে, সে পানি মানে ও দামের প্রতিযোগিতায় দেশের যে কোনো পানির চেয়ে মানসম্পন্ন। গ্রাহক সেবা সম্পর্কে তিনি বলেন, এক সময় ওয়াসার পানির বিল দিতে হলে ভোগান্তির অন্ত ছিল না গ্রাহকদের। সেই বিল কার্যক্রম এখন মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমেই পরিশোধ করা যাচ্ছে। আর তা জমা হচ্ছে ২৯টি ব্যাংক একাউন্টে। এ ছাড়া গ্রাহকদের যে কোনো অভিযোগ জানানোর জন্য চালু করা হয়েছে ১৬১৬২ নম্বরের ওয়াসা লিংক।

ঢাকা ওয়াসা জানিয়েছে, সংস্থাটিকে একটি যুগোপযোগী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচি গ্রহণ করে ভালো ফল পেয়েছে। এতে করে পানির সিস্টেম লস ৪০ ভাগ থেকে কমে ২২ ভাগে নেমে এসেছে। পরিচালন ব্যয় কমেছে প্রায় ৩৩ ভাগ। রাজস্ব আয়ও দিন দিন বাড়ছে। সর্বশেষ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৯০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে রাজস্ব আয়। এ ছাড়া বর্তমানে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হারও সন্তোষজনক, ২২ ভাগ। এখন আয় বাড়লেও কমেছে ব্যয়।

প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, ২০০৯ সালে ঢাকা শহরে পানির জন্য হাহাকার ছিল। শুষ্ক মৌসুমে বিভিন্ন মিছিল, মিটিং ও ভাঙচুর হতো। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বর্তমানে আমাদের সেই পরিস্থিতি নেই। ঢাকা শহরে কোথাও পানির হাহাকার নেই।

তিনি বলেন, সার্কভুক্ত দেশগুলোর কোনো শহরেই পাবলিক সেক্টরে ২২ ভাগের নিচে সিস্টেম লস নাই। ঢাকা ওয়াসা সেদিক থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এ ছাড়া পানির পাইপ লাইন পরিবর্তনের জন্য ডিস্ট্রিক মিটারিং এরিয়া (ডিএমএ) পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এটা চালুর কারণে পুরো রাস্তা কাটতে হবে না। ভেতর দিয়ে মেশিনের মাধ্যমে ওপরে পানির পাইপ লাইন বসিয়ে দেয়া যাবে। তিনি বলেন, একসঙ্গে পানি ব্যবস্থাপনায় না গিয়ে এডিবির সহায়তায় ভাগ ভাগ করে কম্পিউটার সিস্টেমে পানি ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। আড়াই বছর আগে শুরু হওয়া এ প্রকল্পটি শেষ হতে আরো সময় লাগবে প্রায় ২ বছর।

বর্তমানে ঢাকা ওয়াসায় বৈদেশিক ইনভেস্টমেন্টের কথা উল্লেখ করে তাকসিম এ খান বলেন, একটা সময় ছিল ঢাকা ওয়াসায় কেউ ইনভেস্ট করত না। ২০০৬-০৭-০৮ সালে ঢাকা ওয়াসায় ১০ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ ছিল না। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। এই বিনিয়োগে প্রমাণ হয় যে, ঢাকা ওয়াসা সক্ষমতা অর্জন করেছে। তিনি বলেন, সংস্থাটির বর্তমান ম্যানেজমেন্ট অত্যন্ত শক্ত যে কারণে দাতারা ঋণ দিতে দ্বিধা করে না। তাদের প্রদেয় ঋণের টাকা আমরা পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করছি। সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার উদ্বোধনের সময় দাতা সংস্থা ডেনমার্ক একথা স্বীকার করেছে। এর পর থেকে ডেনমার্ক আজো ঢাকা ওয়াসায় অর্থায়ন করে যাচ্ছে। মোট কথা ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত এই ৬ বছরে ঢাকা ওয়াসায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।