টানা অবরোধ ও হরতালের মধ্যেও দেশের রপ্তানি আয় গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরের মার্চ মাসে গত বছরের মার্চ মাসের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। এ ছাড়া দেশের রপ্তানি কনটেইনার হ্যান্ডলিং গত বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় ১২ শতাংশ বেড়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), আইসিডি কর্তৃপক্ষের হিসাবে এই তথ্য জানা গেছে। তবে রপ্তানি হওয়া পণ্যের বেশিরভাগই তৈরি পোশাক খাতের বলে জানিয়েছেন ইপিবি। কিন্তু সহিংসতা ও আতঙ্ক না থাকলে এ সময় রপ্তানি আয় আরও বাড়ত বলে মনে করেন রপ্তানিকারকরা।
ইপিবির দেওয়া তথ্যমতে, অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) রপ্তানি খাতে বাংলাদেশের আয় হয়েছে ২ হাজার ২৯০ কোটি ৪ লাখ মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ বেশি। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের নবম মাস মার্চে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ২৫৯ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার। গত মার্চে যা ২৪০ কোটি মার্কিন ডলার ছিল। ফলে চলতি অর্থবছরে গত বছরের এই সময়ের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছে ৭ শতাংশ।
ইপিবির দেওয়া তথ্যমতে, জানুয়ারি মাসে রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় ৫ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসে ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ বেশি রপ্তানি আয় হয়েছে।
তবে এখনকার এই অস্থিরতার প্রভাব আগামীতে ঠিকই পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি একেএম সেলিম ওসমান। তিনি বলেন, এখন আমাদের রপ্তানির মৌসুম চলছিল। সহিংসতা না থাকলে অর্থবছরের বাকি মাসগুলোতেও রপ্তানি আয় বাড়ত। এর প্রভাব বছরের শেষে বোঝা যাবে। গত ৩ মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। বায়াররা অর্ডার বাতিল করে দিচ্ছে। এর প্রভাব দেখা যাবে কয়েক মাস পর। অবশ্য সব বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে অর্থবছর শেষে রপ্তানি আয় ইতিবাচক ধারাতেই রাখা সম্ভব হবে বলে আশা করেন তিনি।
ইপিবির দেওয়া তথ্যমতে, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে মোট রপ্তানি আয়ের বেশিরভাগই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এর মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ৯৫৫ কোটি ডলার ও ওভেন পোশাকে এসেছে ৯৬৮ মিলিয়ন ডলার।
এ বিষয়ে ইপিবির এক কর্মকর্তা বলেন, হরতাল-অবরোধের মধ্যেও বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বেড়েছে। অবরোধের মধ্যে আমাদের রপ্তানি অব্যাহত ছিল। ওই সময়ে রপ্তানি পণ্য বন্দরে পৌঁছাতে পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। ইউরোপের বাজারে আমরা বেসিক পোশাকের ৪০ শতাংশ রপ্তানি করে থাকি। আমরা যে দামে ভালোমানের পোশাক রপ্তানি করি, তা অন্য কোনো দেশ দিতে পারবে না। যত সমস্যাই হোক না কেন, বাংলাদেশ থেকে বায়াররা মুখ ফিরিয়ে নেবে না বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে অবরোধ-হরতালের মধ্যে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের রপ্তানি কনটেইনার হ্যান্ডলিং ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেড়েছে বলে কমলাপুর ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) সূত্র জানায়।
আইসিডি সূত্র জানায়, চলতি বছরের গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে কমলাপুর ডিপো থেকে ১৮ হাজার ৭২২টি কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয়েছে। একই সময় গত বছর ১৬ হাজার ৩৬৬টি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। সে হিসাবে এ বছর ১২ শতাংশের বেশি রপ্তানি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। এর মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ৭২০টি বক্স ও ২ হাজার ৮৫৯টি টিউস কনটেইনার ওঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৬০৯টি বক্স এবং ২ হাজার ৭১৮টি টিউস কনটেইনার নামানো হয়েছে। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ১ হাজার ৮২৮টি বক্স এবং ৩ হাজার ৮৮টি টিউস কনটেইনার ওঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৮৫৪টি বক্স এবং ৩ হাজার ৪০টি টিউস কনটেইনার নামানো হয়েছে। পাশাপাশি গত বছর জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ৪১৬টি বক্স এবং ২ হাজার ৩৬৪টি টিউস কনটেইনার ওঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৪১৪টি বক্স এবং ২ হাজার ২৯১টি টিউস কনটেইনার নামানো হয়েছে। ওই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ১ হাজার ৬৯৮টি বক্স এবং ২ হাজার ৭০৯টি টিউস কনটেইনার ওঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৬৯৫টি বক্স এবং ২ হাজার ৭৭৫টি টিউস কনটেইনার নামানো হয়েছে। সেই হিসাবে গত বছরের তুলনায় এ বছর ২ হাজার ৩৫৬টি কনটেইনার বেশি হ্যান্ডলিং করা হয়েছে রাজধানীর কমলাপুর ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোতে।
এ ব্যাপারে কমলাপুর আইসিডির ট্রাফিক ব্যবস্থাপক আহমেদুল করীম চৌধুরী বলেন, দেশের চলমান অবরোধ-হরতালের কারণে কমলাপুর আইসিডিতে তেমন প্রভাব পড়েনি। গত বছরের তুলনায় এ বছর আমদানি-রপ্তানি কনটেইনার হ্যান্ডলিং অনেকটাই বেড়েছে। স্বাভাবিক গতিতেই কনটেইনার ওঠানো-নামানো হচ্ছে।
এ ব্যাপারে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, এখন আমাদের রপ্তানির ব্যস্ত মৌসুম চলছে। নভেম্বর মাস থেকেই রপ্তানি আয় বাড়ছিল। কিন্তু বর্তমান অস্থিরতার প্রভাব আগামীতে পড়বে রপ্তানি আয়ে। বায়াররা অর্ডার বাতিল করে দিচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে কয়েক মাস পর।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, হরতাল-অবরোধে নানা বাধার মধ্যেও ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি খারাপ নয়। তবে সমস্যার সমাধান না হলে আমাদের রপ্তানি খাত বড় ধরনের সংকটে পড়বে। এই সংঘাত-সহিংসতা না থাকলে অর্থবছরের বাকি মাসগুলোতেও রপ্তানি আয় বাড়ত। এখন যে অস্থিরতা চলছে, তার প্রভাব পড়বে ৬ মাস-এক বছর পর।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আমাদের সময়কে বলেন, টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল, তেলের দাম কমার ফলে ভর্তুকির চাপ কম, বৈদেশিক আয়-ব্যয়ের স্থিতি উদ্বৃত্ত। অর্থনীতির প্রধান এই সূচকগুলো ইতিবাচক থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে তেজীভাব নেই। যার কারণ অনুদার রাজনৈতিক পরিবেশ। যার ফলে অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক সংস্কার না হলে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব না বলে মনে করেন তিনি।