সময়ের প্রয়োজনেই সারাবিশ্বে এখন বাড়ছে মোবাইল ফোনে উপযোগী অ্যাপ্লিকেশন বা অ্যাপসের ব্যবহার। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। ইতোমধ্যে বেশকিছু দেশীয় প্রতিষ্ঠান অ্যাপস তৈরির কাজ শুরু করেছে। মাত্র তিন-চার বছরেই অ্যাপস থেকে রফতানি আয়ের পরিমাণ এখন ২শ’ কোটি টাকারও বেশি। এ খাতের উদ্যোক্তরা বলছেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হলে শুধু অ্যাপস রফতানি থেকেই আগামী চার বছরে আট হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
অ্যাপস হল এক ধরনের সফটওয়্যার যা স্মার্টফোনে ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সেবার পাশাপাশি নানা ধরনের প্রযুক্তিগত সহায়তা পাওয়া যায়। গেম, ক্যালেন্ডার, মিউজিক প্লেয়ার থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সেবা মেলে এর মাধ্যমে। শুরুতে হ্যান্ডসেট কোম্পানিগুলোই বিভিন্ন ধরনের অ্যাপস তৈরি করে স্মার্টফোনের সঙ্গে জুড়ে দিত। এখনও কিছু অ্যাপস স্মার্টফোনে আগে থেকেই প্রবেশ করানো থাকে। কিছু অ্যাপস অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনে গুগলের প্লে স্টোর, অ্যাপলের আইফোনের জন্য অ্যাপস্টোর থেকে ডাউনলোড করে ব্যবহার করা যায়।
ইন্টারন্যাশনাল টেলিকম ইউনিয়নের (আইটিইউ) সূত্র মতে, ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আর এই সময়ে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা হবে এক হাজার কোটিরও উপরে।
আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গার্টনার বলছে, বর্তমানে বিশ্বে মোবাইল অ্যাপসের বাজার রয়েছে আড়াই হাজার কোটি ডলারের। প্রতিবছর মোবাইল অ্যাপস ব্যবহার ২৯.৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৭ সাল নাগাদ এর বিশ্ববাজার হবে ৭ হাজার ৭শ’ কোটি ডলার। এ সময়ের মধ্যে বেশিরভাগ ব্যবহারকারী হবে এশিয়া অঞ্চলের। অ্যাপস তৈরির মাধ্যমে আয়ের দিক থেকে এখন শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও যুক্তরাজ্য।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ২৬ লাখ ৫৭ হাজার। আর মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪ কোটি ২০ লাখ।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) অন্তর্ভুক্ত প্রায় ১শ’টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে মোবাইল অ্যাপস তৈরির কাজ করা হয়। এর বাইরে আরও অন্তত ১শ’টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা মোবাইল অ্যাপস তৈরি করছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের অনেকেই এখন অ্যাপস তৈরি করছেন।
বেসিসের সভাপতি শামীম আহসান সকালের খবরকে বলেন, সফটওয়্যার ও আইটি সার্ভিসেস থেকে বর্তমানে বাংলাদেশের রফতানি আয় হয় ২৫ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে মোবাইল অ্যাপস থেকেই আয় আড়াই কোটি মার্কিন ডলার।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালের মধ্যে সফটওয়্যার এবং আইটি সার্ভিসেস থেকে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করছি, এর মধ্যে ৫শ’ মিলিয়ন ডলার আয় হবে অ্যাপস থেকে।
প্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য প্রতিনিয়ত বাংলা ভাষায় অ্যাপস তৈরি করছেন দেশীয় ডেভেলপাররা। এর মধ্যে রয়েছে মোবাইলে বাংলা লেখার জন্য ‘মায়াবি কিবোর্ড’। আইনি সহায়তা ও আইন প্রক্রিয়া জানতে ‘ল সাপোর্ট’। বাংলায় পবিত্র কোরান শরিফের জন্য ‘আল-কোরান (বাংলা)’, শিশুদের বাংলায় গণিত শিক্ষার জন্য ‘ম্যাথ ফর কিডস ইন বাংলা’ অ্যাপস রয়েছে। রান্নার কলাকৌশলের জন্য ‘রেসিপি (বাংলা)’, বিনামূল্যে বই পড়তে ‘বই পোকা’, ‘বাংলা ডিকশনারি’, ‘বাংলা রাশিফল’ রয়েছে। এ ছাড়াও কৃষি, বাণিজ্য, শিক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, জীবনধারা, সংবাদ, পর্যটন বিষয়ক অ্যাপ তৈরি হয়েছে।
অ্যাপসের উন্নয়ন ও ব্যবহার বাড়াতে মোবাইল অপারেটররাও বিভিন্ন সময়ে নিয়েছে নানা উদ্যোগ। ২০০৮ সালে দেশে অ্যাপস তৈরির সূচনা করে গ্রামীণফোন। নাম দেওয়া হয় ‘আলো আসবেই’। বর্তমানে অপারেটরটি ‘জিপি স্টোর’ নামে আরেকটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দেশীয় ডেভেলপারদের তৈরি অ্যাপস সেবা দিচ্ছে। দেশের ডেভেলপারদের তৈরি অ্যাপস যাতে গ্রাহকরা সহজেই পেতে পারে সে জন্য গত বছরের ডিসেম্বরে ‘বিডি অ্যাপস’ নামে একটি অ্যাপস স্টোর চালু করে আরেক মোবাইল অপারেটর রবি। এ ছাড়া ‘বাংলালিংক মেলা’ নামে একটি অ্যাপস স্টোর আছে বাংলালিংকের। এসব অ্যাপস স্টোর থেকে যে আয় হয় তা অপারেটর ও অ্যাপস ডেভেলপার-দুই পক্ষের মধ্যে সমানভাবে ভাগ হয়। ডেভেলপারদের সহায়তা করার পাশাপাশি নতুন কোনো ধারণাকে কাজে লাগিয়ে তা কার্যকর পণ্যে পরিণত করতে সহায়তা করছে অপারেটররা।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ ‘জাতীয় পর্যায়ে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন উন্নয়নে সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি’ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ২০১৬ সালের মধ্যে দেশে ১০ লাখ ‘অ্যাপস ডেভেলপার’ তৈরির লক্ষ্যে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই)’ কার্যক্রমের আওতায় ২০১৩ সাল থেকে চলমান এ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের আইসিটি স্নাতক, তথ্যপ্রযুক্তিতে আগ্রহী তরুণদের অ্যাপস বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। যার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় এবং বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যান্ড্রয়েড ভিত্তিক ৫০০ অ্যাপস তৈরি করা হবে। এর মধ্যে ৩০০ অ্যাপস সরকারের মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর তথ্য ও সেবার ওপর এবং অবশিষ্ট ২০০ অ্যাপস প্রতিযোগিতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে পাওয়া নতুন সৃজনশীল ধারণার ওপর।
এ ছাড়া দেশের বেশ কয়েকটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে মোবাইল অ্যাপস বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন অ্যাপস প্রতিযোগিতা, হ্যাকাথন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অনেক তরুণ উঠে আসছেন, যাদের দক্ষতা বিশ্বমানের।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশে অ্যাপসের বিরাট সম্ভাবনা থাকলেও বিশ্ববাজারে ঢুকতে এখনও কিছু বাধা রয়েছে। উদ্যোক্তরা বলছেন, গুগলের অ্যাপস স্টোর গুগল প্লে থেকে অ্যাপস ডাউনলোড থেকে অর্থ পাওয়ার জন্য গুগলের স্বীকৃতি পাওয়ার যে বিধান রয়েছে তা বাংলাদেশের নেই। ফলে অ্যাপস ডেভেলপাররা অ্যাপস আপলোড করে কোনো অর্থ পান না। আবার গুগল প্লে স্টোরে বিনা মূল্যে অ্যাপস আপলোড করতে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ২৫ ডলার দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে অনেক ধরনের শর্তের কারণে একজন ডেভেলপারের পক্ষে এ অর্থ দিয়ে নিবন্ধন করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সফটওয়্যার খাতের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ছাড়াই ৩০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত লেনদেনের সুযোগ করে দিতে একটি নির্দেশনা জারি করেছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেনি। ফলে গুগলে নিবন্ধন করার সুযোগবঞ্চিত হচ্ছেন অ্যাপস তৈরিকারীরা।