সম্ভাবনাময় অর্থনীতি

আতিউর রহমান

শত প্রতিকূলতা পায়ে দলে বিপুল আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। তবে ১৯৭১-এ স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশ টিকে থাকার এক তীব্র লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাজুক ও ভঙ্গুর আর্থ-সামাজিক অবস্থায় পশ্চিমা অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের পরীক্ষাগার’ হিসেবে ভাবতে থাকেন। অনেকেই হতাশ ছিলেন এবং এর স্থায়িত্ব নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তারা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের পৃথক হওয়াকে অদূরদর্শী ও হঠকারী সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন। অনেকে এও আশঙ্কা করেন, কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। কিন্তু বাংলাদেশ সব কাল্পনিক ও অন্ধকারময় পূর্বাভাস ভুল প্রমাণ করে অভাবনীয়ভাবে ধ্বংসাবশেষ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে আসে।
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবসায়িক খাতকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব টেকসই অর্থায়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে আসছে। এই কৌশলের কারণে বৈশ্বিক আর্থিক সংকট ও প্রবৃদ্ধি-মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে ছয় শতাংশের ওপর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। ২০১১-এর পর থেকে ভোক্তা মূল্যস্টম্ফীতি ধীরে ধীরে কমছে। এই অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের মূল্যস্টম্ফীতির উত্থান-পতন সর্বনিম্ন, যা বিদেশি বিনিয়োগকারী আকর্ষণে সামষ্টিক স্থিতিশীলতার শক্তিশালী ভিতের পরিচয় বহন করে। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার ক্রমবর্ধমান মজুদ ও বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সে অব্যাহত প্রবৃদ্ধি বজায় রেখে অর্থবছরের প্রথম আট মাস শেষে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই বর্তমানে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এফডিআই বেশি হোক_ সে জন্য জোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সহজে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার পথ তার নীতি সংস্কারের মাধ্যমে সুগম করে দিচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সে জন্য দ্রুতই বিশেষ শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৪৪ বছরের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ২৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যা দিয়ে ছয় মাসের অধিক সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। ২০১৩-এর মাঝামাঝি থেকে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারও স্থিতিশীল অবস্থানে রয়েছে। মূল্যস্টম্ফীতি নিম্নগামী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত ও ঋণের সুদহারও ধীরে ধীরে কমে আসছে। ব্যাংকিং খাতে আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান বা স্প্রেড এখন পাঁচ শতাংশীয় পয়েন্ট, যা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন উন্নয়নের প্রতিফলন।
আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতার পাশাপাশি পুঁজিবাজার উন্নয়নেও বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়ক ভূমিকা রাখছে। পুঁজিবাজারের সমর্থনে বিশেষ পুনঃঅর্থায়ন কার্যক্রম চালু রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নানা ধরনের বৈদেশিক লেনদেন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের বিনিয়োগবান্ধব উদারীকরণ এনেছে। এরূপ সংস্কারের মধ্যে অন্যতম হিসেবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানিগুলোতে বিদেশি ইক্যুইটি দেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রির জন্য মূল্যায়নে নিট সম্পদ মূল্যের পরিবর্তে বাস্তবসম্মত বাজারভিত্তিক মূল্যায়ন গ্রহণযোগ্য করে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা জারি করেছে।
বাংলাদেশের আর্থিক বাজারের অসম্পূর্ণ বিকাশ মুদ্রানীতির কার্যকারিতার ট্রান্সমিশন চ্যানেলগুলোকে অপ্রতুল রেখেছে। পরিণত অবসর জীবনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পেনশন ও প্রভিডেন্ট ফান্ড সঞ্চয় ব্যবস্থার অভাব এ ক্ষেত্রে একটি গুরুতর অপ্রতুলতা, যা মুদ্রানীতির কার্যকারিতা সীমিত করা ছাড়াও অবকাঠামো ইত্যাদি খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের অর্থায়ন জোগান না থাকার একটি বড় কারণ। উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারতেও সরকারি-বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক খাতে চাকরিজীবীরা ছাড়াও ব্যাপক সাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্য পেনশন ও প্রভিডেন্ট ফান্ড সঞ্চয় ব্যবস্থা চালু রয়েছে। বাংলাদেশে এই ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছে। সরকারও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি কার্যকর। এটি আর্থিক বাজার উন্নয়ন এবং অর্থনীতির প্রকৃত খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকে সহায়তা করছে।
এ অঞ্চলের মধ্যে সর্বনিম্ন ঋণ-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশ সরকারের জন্য উৎপাদনশীল খাতে ঋণ গ্রহণের সুযোগকে নির্দেশ করে, যা প্রবৃদ্ধি সহায়ক অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণে ব্যবহৃত হতে পারে। সরকার নতুন নতুন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। এই বিশেষ শিল্পাঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগকারীদের ট্যাক্স, ভ্যাট ও স্ট্যাম্প ডিউটি থেকে অব্যাহতি প্রদানের মতো বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের কথা ভাবছে। বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশ এশিয়া ও প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক এবং বিনিয়োগের সুবিধার দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সমন্বিত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বে অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশকে বিশেষ করে মোটর গাড়ি যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস পণ্য, তৈরি পোশাক এবং নানা ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে ব্যয়সাশ্রয়ী ভিত তৈরিসহ নানা সুবিধা দিচ্ছে।
বাংলাদেশ আঞ্চলিক সহযোগিতার সুবিধাগুলো কাজে লাগাচ্ছে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) সক্রিয় সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, ভুটান, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর জন্য বিনিয়োগ সুবিধার দুয়ার খুলে দিয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ শুধু সংস্কৃতি, ইতিহাস, জনমিতিক বৈশিষ্ট্য ও অর্থনৈতিক পরিবেশের দিক থেকে অভিন্ন নয়; নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণের দিক থেকেও দেশ দুটি প্রায় অভিন্ন। উভয় দেশ নব্বই দশকের শুরু থেকেই বাজার উদারীকরণের নীতি গ্রহণ করেছে এবং বাণিজ্য ও শিল্প আরও উদারীকরণের দিকে নীতিনির্দেশনা প্রণয়ন করেছে। এর ফলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য দ্রুত বেড়েছে। ভারত ইতিমধ্যে যৌথ গ্রিডের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। ভারতীয় ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন, গ্যাস উত্তোলন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। রেলওয়ে খাতে বিশাল অভিজ্ঞতা ও কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন ভারত আমাদের রেলওয়ে খাতের উন্নয়নেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ইতিহাস, কৃষ্টি এবং অতি অবশ্যই একাত্তরে আমাদের মাটিতে ভারতীয় জনসাধারণ ও সৈনিকের রক্তদানের প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা এ দুটি দেশের গভীর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব এবং পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন উচ্চতায় পেঁৗছে গেছে। এই সুসম্পর্ক গত অর্ধ দশকে নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে দেশে বর্তমানে অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন রূপকল্পের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশ দ্রুত ম্যানুফ্যাারিং, অবকাঠামো, শিক্ষা ও কারিগরি ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ সম্ভাবনার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বিংশ শতাব্দী শুরুর বেশ কয়েক বছর পর থেকে সরকার প্রবৃদ্ধিকে শুধু অঙ্ক দিয়ে বিবেচনা না করে গুণ-মান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ওপর জোর দেয়। এর ফলে আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে আরও টেকসই হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ যে টেকসইভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে, তার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে গ্রামীণ অর্থনীতি। কৃষি ও এসএমই খাতে ব্যাংকগুলো তাদের অর্থায়ন ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শহর থেকে গ্রামে দ্রুত অর্থ স্থানান্তর হচ্ছে। যার প্রভাবে সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে উচ্চফলন দেখা যাচ্ছে। ফলে কমেছে খাদ্য আমদানি, যা দেশের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব রাখছে। গ্রামে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। এক কথায় গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়েছে।
আমাদের উদ্যোক্তারা এবং সাধারণ মানুষ অত্যন্ত সাহসী ও পরিশ্রমী। তারা প্রয়োজনে বড় ঝুঁকি নিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তারা এগিয়ে যায়। এই উদ্যমী মানুষের ‘রেসিলিয়েন্স’ হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তি। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ও গ্রামাঞ্চলে মানুষের অর্থায়নের আরও সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব, যা আমাদের ৮৫ হাজার গ্রামের উন্নয়নের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনকে আরও ত্বরান্বিত করবে।
ষ গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক