স্বপ্ন ওদের স্বাবলম্বী হওয়া

 

শারমিন আক্তারের বয়স ষোল কিংবা সতের। সে একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তার কোনো কিছু মনে থাকে না। যথাযথভাবে যোগাযোগের ক্ষমতা নেই। এই প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে শারমিন এখন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার হস্তশিল্প কারিগর হিসাবে মাসে চারশ’ টাকা আয় করছে। টাকার পরিমাণ সামান্য হলেও শারমিনের এই অর্জন সামান্য নয়। দরিদ্র বাবা হামিদ উদ্দিন আর মা হালিমা খাতুনের সাত ছেলে-মেয়ে। তার ওপর শারমিন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তাই বাবা-মা সেভাবে তার দায়িত্ব নিতে পারেনি। উপরন্তু বোঝা কমাতে শারমিনকে ঢাকায় অন্যের বাড়িতে গৃহশ্রমিকের কাজে পাঠান। সেখানে শারমিনের জন্য আর এক অধ্যায় সূচিত হয়। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় সে নিজের কাজটুকু নিজেই বুঝে করতে পারে না। ফলে পদে পদেই তাকে গালমন্দ শুনতে হতো। অগত্যা শারমিনকে সেই বাড়ি ছাড়তে হলো। গৃহশ্রমিকের কাজ ছেড়ে শারমিন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সেখান থেকে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় তার জায়গা হয়। তারাই শারমিনকে ইউসেপ স্কুলে নিয়ে আসে। শারমিন এখন এই প্রতিষ্ঠানের গার্মেন্টস ইউনিটের একজন শিক্ষার্থী।

শুরুর গল্পটা একটু ভিন্ন হলেও একই পথের পথিক আসমানী সিদ্দিকা। স্কুল শিক্ষক বাবা আবু বকর সিদ্দিক ও মা রেনু আরার তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় আসমানী। অন্য ভাই-বোনরা পড়াশোনা করলেও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী আসমানীর স্কুলে যাওয়া হয়নি নিয়মিত। তাই বলে সে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেনি। বড় বোনের মিরপুরের বাসায় থেকে একই প্রতিষ্ঠানে একই ইউনিটে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্নে প্রত্যয়ী আসমানী।

ইউসেপের প্রধান নির্বাহী পরিচালক জাকী হাসান ইত্তেফাককে জানান, শুধু বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নয় তাদের প্রতিষ্ঠানে শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুরাও ভকেশনাল শিক্ষা নিয়ে কাজে প্রবেশ করছে। কাজে যোগ দেয়ার পর তাদের সম্পর্কে কোনো অভিযোগও পান না তারা। তাদের ক্ষেত্রে নেই বেতন বৈষম্যও। তবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাদের কাজ দিতে অনেকে অনীহা প্রকাশ করেন বলে জানান জাকী হাসান। তিনি বলেন, ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল অবধি ইউসেপ বাংলাদেশ স্কুল ৪ হাজার ৬৭২ জন সুবিধা বঞ্চিত শিশুকে কারিগরি শিক্ষা দিয়েছে। যার মধ্যে দশ শতাংশই প্রতিবন্ধী।

বাংলাদেশ থানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১০ মতে, দেশের প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ৯ দশমিক ০৭ শতাংশ। এই বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে রাখা সমীচীন নয়, তাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণের পথ সুগমকরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারপারসন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। তিনি বলেন, তাদের শিক্ষা সাধারণের মতো নয়। প্রতিবন্ধকতা সত্যেও তারা যে কারিগরি শিক্ষা নিয়ে কাজে প্রবেশ করছে এটা অনেক বড়। আমদের দেশে এমন শিশুদের শিক্ষার সুযোগ কতটা তাও আমাদের দেখতে হবে।

তবে শিক্ষার সুযোগের চেয়ে তাদের খুঁজে বের করা বেশি কঠিন মনে করেন জাকী হাসান। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীদের বান্ধব করে এখনও প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে ওঠেনি। যাতায়াত প্রতিবন্ধীদের অন্যতম প্রধান সমস্যা। কার্যালয়ে আগুন লাগলে হুইল চেয়ারে বসা ব্যক্তি তাড়াতাড়ি নেমে যাবে সেই সিঁড়িও নেই বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে। স্কুলগুলোতে একই অবস্থা বলে উল্লেখ করেন তিনি।

আর এই সকল বিষয়ে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে সচিব তারিক-উল ইসলাম বলেন, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে তার মন্ত্রণালয়ে এরূপ কোনো কার্যক্রম নেই। সমাজসেবা মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধীদের বিষয় দেখে। এই বিষয় প্রতিবন্ধীদের খুঁজে বের করা কঠিন নয় বলে দ্বিমত প্রকাশ করেন সমাজ সেবা অধিদপ্তরের প্রতিষ্ঠান বিভাগের পরিচালক জুলফিকার হায়দার।

তিনি বলেন, সরকার প্রতিবন্ধীদের পরিসংখ্যান করেছে। তাই দেশের কোথায় কোন প্রতিবন্ধী কতজন আছে তা আমাদের জানা। তিনি বলেন, শিশুদের কারিগরি শিক্ষা দেয়ার জন্য সরকারের ৬টি স্কুল আছে। যার মধ্যে দুটি প্রতিবন্ধীদের জন্য। দাউদকান্দির কুমিল্লায় ও মাদারীপুরের শিবচরে অবস্থিত এই দুটি স্কুলে ৬০ জন করে ছেলে ও ৪০ জন মেয়ে অর্থাত্ মোট দুইশ’ শিশুর শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে তাদের শিক্ষার্থী কোটা পূর্ণ হয় না বলেও তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, নিয়োগবিধিতে সংস্থান নেই বলে তাদের কিছু বিভাগে এখন শিক্ষক নেই। তাই সেই সকল বিভাগে শিক্ষা প্রদান হয় না। শিক্ষক নিয়োগ হলে সেই বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার সুযোগ পাবে। তবে এটা একটি সময় সাপেক্ষ বিষয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।