স্ট্র্রবেরি চাষ ও হস্তশিল্পে বদলে যাচ্ছে জীবন

একসময় বনাঞ্চলের গাছপালা কেটে সাবাড় করতেন তাঁরা। বনই ছিল তাঁদের জীবিকার স্থান। জীবনের তাগিদে অবৈধভাবে উজাড় করেছেন বন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নিজেদের প্রচেষ্টায় তাঁরা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে ফেলছেন। আর বননির্ভর থাকছেন না। প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেছেন স্ট্রবেরি চাষ। চলছে সেলাই ও টুপি তৈরিসহ নানা ধরনের হস্তশিল্পের কাজ। এতে রক্ষা হচ্ছে বন ও পরিবেশ। আর সচ্ছল জীবনযাপন করছেন বনের ওপর নির্ভরশীল এসব লোকজন। তাঁদের সফলতা দেখে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন অন্যরাও। এরই মাধ্যমে একজন লোকও আর বননির্ভর থাকবেন না- এমনটাই বলছেন কক্সবাজারের চকরিয়ার খুটাখালী, ফাঁসিয়াখালী ও ডুলাহাজারার লোকজন।

চকরিয়া উপজেলার খুটাখালীর মাইজপাড়া, ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও ডুলাহাজারার মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের বনভূমির পাশেই এখন চোখে পড়বে বিশাল এলাকায় স্ট্রবেরির সবুজ ক্ষেত। যাঁরা একসময় বনের গাছপালা উজাড় করতেন সেইসব লোকজন প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকায় চাষ করেছেন অত্যধিক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এই স্ট্রবেরি। বাম্পার ফলনও হয়েছে। আর এই স্ট্রবেরি বিক্রি করে সচ্ছল জীবনযাপন করছেন বননির্ভর থাকা লোকজন। একইভাবে নারীরাও দারিদ্র্যতা জয় করছেন সেলাইসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণ নিয়ে। তাঁরা সেলাই করছেন কাপড়। তৈরি করছেন পুতুল ও টুপিসহ নানা ধরনের শো-পিচ। এতে তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। এলাকায় বিকল্প আয়ের পথে বর্তমানে পাঁচ সহাস্রাধিক লোক রয়েছে বলে জানা গেছে। তাঁদের দেখাদেখি অন্যরাও আগ্রহী হয়ে ওঠছেন। এসব কাজে তাঁদের প্রশিক্ষণসহ নানাভাবে সহযোগিতা করছেন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং ইউএসএইড-এর যৌথ প্রকল্প ক্লাইমেট রিজিলেন্ট ইকো সিস্টেম অ্যান্ড লাইভলিহোডের (ক্রেল) কর্মকর্তারা।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা শাহ ই আলম গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে জানান, মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বন ও পরিবেশ রক্ষার তাগিদে তৃণমূলের লোকজনকে বিকল্প আয়ের পথে উদ্বুদ্ধ করাই প্রধান লক্ষ্য।

স্ট্রবেরি চাষ করে ভাগ্য বদলে গেছে অনেকের।

খুটাখালীর চড়িবিল এলাকায় স্ট্রবেরি চাষ করে সাফল্য পাওয়া হুমায়ুন কবির (৩৩) বলেন, ‘আমি বনের গাছ ও লাকড়ি বিক্রি করে সংসার চালাতাম। পরে রাজশাহী জেলায় গিয়ে স্ট্রবেরি চাষের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে আসি। এখানে এসে ১৫ শতক জমিতে দেড় হাজার স্ট্রবেরি চারা লাগিয়ে চাষ শুরু করি। গেল ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকে ফল তোলা শুরু হয়। এই পর্যন্ত ২৫০ কেজি স্ট্রবেরি তুলেছি ক্ষেত থেকে। এসব ফল ধরন অনুযায়ী বক্সপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে ইতিমধ্যে ৭০ হাজার টাকা পেয়েছি। আরো ১ থেকে ১৫০ কেজি ফল বিক্রি করতে পারব। স্ট্রবেরি ক্ষেত থেকে ১২/১৫ হাজার চারাও উৎপাদন করতে পারব। এই চারা বিক্রি থেকে আসবে অনেক টাকা।’

ডুলাহাজারা উত্তর মেধাকচ্ছপিয়ার নুরুচ্ছফার কন্যা তছলিমা বেগম (১৫) বলেন, ‘আমি আগে জঙ্গল কেটে সংসারের খরচ জোগাতে সহযোগিতা করতাম। পরে নিজের প্রচেষ্টায় জীবনের মোড় ঘুরিয়ে ফেলেছি। আমার হাতে বানানো পুতুল ঢাকার হাতে বুনুন নামে একটি কম্পানি কিনে নেয়। আর এসব পুতুল তৈরি করে দৈনিক ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আয় করছি।’

এলাকায় তছলিমার মতো আরো শতাধিক নারী এই কাজ করছেন। তাঁরাও সবাই বনের গাছপালার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। একইভাবে রোজিনা আক্তার নামে এক গৃহবধূ জানান, তাঁর স্বামী জঙ্গলের গাছ কেটে ও লাকড়ি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এই অল্প আয়ে তিন সন্তান নিয়ে তাঁদের সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। পরে তিনি সেলাই প্রশিক্ষণ নেন এবং জীবনের চিত্র বদলে ফেলেন। তাঁর সংসার এখন সুখের।

খালেদা বেগম নামে আরেক নারী জানান, তিন বছর আগে জঙ্গলে গাছ কাটতে গিয়ে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। পরে প্রশিক্ষণ নেন টুপি তৈরির। তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরাও টুপি তৈরি করতে পারেন। এই কাজ করে তাঁরা দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করেন। এতে তাঁর সংসার খুব ভালোভাবেই চলে। তাঁকে সহযোগিতা করছে ক্রেল প্রজেক্ট।

ক্রেল কর্মকর্তা মো. আব্দুল কাইয়ুম জানান, বনের ওপর নির্ভরশীলতা কীভাবে কমানো যায় সেই প্রচেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছে এনজিও সংস্থা ক্রেল প্রজেক্ট। এরা স্ট্রবেরি, সেলাই, টুপি, পুতুল, ঝুড়ি ইত্যাদি হাতের কাজের ওপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বননির্ভর লোকজনকে। তিনি বলেন, ‘বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিকল্প ব্যবস্থায় জীবনযাপনের জন্যই আমাদের এই চেষ্টা। ইতোমধ্যে আমরা সফলও হচ্ছি। আশার কথা, একটা সময় একজন লোকও বননির্ভর থাকবেন না। এতে রক্ষা পাবে বন ও পরিবেশ।’

ডুলাহাজারা ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রহিম উদ্দিন জানান, ডুলাহাজারার মেধাকচ্ছপিয়াসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় যেসব লোকজন পাহাড়ের বনের ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করতেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। স্ট্রবেরি চাষ, সেলাইসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাঁরা স্বনির্ভর হয়ে পড়েছেন। উন্নত হচ্ছে জীবনযাত্রার মান। এছাড়া সফল লোকজনের দেখাদেখি অন্যরাও এগিয়ে আসছেন। এতে করে লোকজনের মধ্যে দারিদ্র্যতা কমছে। আর রক্ষা হচ্ছে বন ও পরিবেশ।