টানা ছয় বছর নেতিবাচক ধারার পর দেশে আবার কলার উৎপাদন বেড়েছে। ২০০৭ সাল থেকে কলা চাষ ও উৎপাদনে ছন্দপতন শুরু। সেটি অব্যাহত থাকে ২০১২ সাল পর্যন্ত। তবে আশার কথা হলো, ২০১৩ সাল থেকে আবার কলা চাষ ও উৎপাদন বাড়তে শুরু করেছে। কলা নিয়ে করা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ বলছে, ওই বছর দেশে কলা উৎপাদনে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৩ সালে সারা দেশে এক লাখ ৭২ হাজার ৮৭২ একর জমির ওপর কলার চাষ হয়েছে। এতে ১৭ লাখ ৮৫ হাজার ২৪৯ মেট্রিক টন কলা উৎপাদিত হয়েছে। যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগের বছর সারা দেশে এক লাখ ১৯ হাজার ৩২৫ একর জমির ওপর কলা চাষ হয়েছিল। সেখানে কলা উৎপাদিত হয়েছিল সাত লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন। সে হিসাবে কলার চাষ ও উৎপাদন বেড়ে দিগুণের বেশি হয়েছে।
জরিপের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ‘কলা’ একটি জনপ্রিয় ফল; যা বেশ সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর। কলা কেবল শরীরে শক্তি জোগায় তা নয় বরং মানসিক, শারীরিক অনেক অসুস্থতা থেকেও প্রতিরোধ করে। একটি কলা প্রায় ১০০ ক্যালরি শক্তির জোগান দেয় এবং সারা দিন শরীরকে সতেজ ও চাঙ্গা রাখতে সহায়তা করে। যে কলার এত পুষ্টিগুণ বাংলাদেশে তার কী পরিমাণ উৎপাদন হয় এবং এর সঙ্গে কত সংখ্যক পরিবার সম্পৃক্ত তা নির্ণয়ের জন্য দেশে প্রথমবারের মতো এই জরিপ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে দেখা গেছে, ২০০৭ সাল থেকে টানা ছয় বছর কলা উৎপাদন নেতিবাচক ধারায় থাকলেও উৎপাদনের হার আবার বেড়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, কলা চাষাবাদ ও উৎপাদনের সঙ্গে এখন সাড়ে পাঁচ লাখ পরিবার সম্পৃক্ত রয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য তিন জেলার চেয়ে সমতল ভূমিতে কলা চাষের হার অনেক বেশি। দেশে সবচেয়ে বেশি চাষাবাদ করা হয় সবরি কলা। এর পরে রয়েছে সাগর কলা।
বিবিএস থেকে প্রকাশিত কৃষি পরিসংখ্যান বই পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এক লাখ ৩১ হাজার ৬৩৬ একর জমির ওপর কলার চাষ হয়েছিল। ওই বছর কলার উৎপাদন হয়েছিল আট লাখ ৭৭ হাজার টনের কিছু বেশি। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে কলার উৎপাদন কমে হয়েছিল আট লাখ ৩৬ হাজার টন। পরের বছর আরো কমে হয়েছে আট লাখ ১৮ হাজার টন। ২০১০-১১ অর্থবছরে কলার উৎপাদন কমে সাত লাখ টনে নেমে আসে। ২০১১-১২ অর্থবছরে তা কমে আসে সাত লাখ ৪৫ হাজার টনে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে উৎপাদন কিছুটা বেড়ে সাত লাখ ৭৪ হাজার টন হয়েছে। তবে বিবিএসের সর্বশেষ জরিপ বলছে, ২০১৩ সালে তা বেড়ে প্রায় ১৮ লাখ টন হয়েছে।
বিবিএসের জরিপ বলছে, ৮৭ শতাংশ পরিবারই তাদের নিজস্ব জমিতে কলা চাষ করে। এ ছাড়া আট শতাংশ পরিবার জমি লিজ নিয়ে কলার চাষাবাদ করে। অন্যদিকে ৭৪ শতাংশ পরিবার তাদের জমিতে শুধু কলা চাষ করে। সেখানে অন্য কোনো ফসল চাষ করে না। বাকি ২৬ শতাংশ পরিবার তাদের জমিতে কলা চাষের পাশাপাশি অন্যান্য ফসলও চাষাবাদ করে। এতে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ পার্বত্য তিন জেলায় ৩৯ হাজার ১৮৪ একর জমির ওপর কলা চাষ করেছেন চাষিরা। বাকি ৫৯ জেলায় এক লাখ ৩৩ হাজার ৬৮৮ একর জমির ওপর কলা চাষ করা হয়েছে।
দেশে কলা উৎপাদনে রেকর্ড
প্রতিবছর সারা দেশে কী পরিমাণ কলা উৎপাদিত হয়, কোন কোন জাতের কলা চাষাবাদ হয় এবং বছর শেষে তা মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কী পরিমাণ মূল্য সংযোজন করে তা নির্ণয়ের জন্য গত বছর এপ্রিলে দেশে প্রথমবারের মতো কলার ওপর জরিপ কাজ শুরু করে বিবিএস। এতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য জেলাকে আলদা করা হয়। অন্যদিকে বাকি ৫৯ জেলাকে আলাদা করে এই জরিপ করা হয়। নমুনা আকারে ২০১৩ সালের তথ্য-উপাত্তের আলোকে এই জরিপ পরিচালনা করে বিবিএস। আগামী মাসে জরিপের ফল প্রকাশের কথা রয়েছে।
বিবিএস বলছে, দেশে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় সবরি জাতের কলা। এই জাতের কলা উৎপাদিত হয় ৩২ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সাগর কলা। এটি উৎপাদিত হয় ২৪ শতাংশ। এর পরে রয়েছে যথাক্রমে বাংলা কলা ২০ শতাংশ ও চম্পা কলা ১৫ শতাংশ। জরিপের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিবিএসের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৩ সালে কলা চাষ করে বেশ লাভবান হয়েছেন চাষিরা। ওই বছর প্রতি কেজি কলা উৎপাদনে খরচ হয়েছে প্রায় চার টাকা। সে কলা বিক্রি হয়েছে ১১ টাকা। আর ওই এক কেজি কলা ভোক্তা কিনেছেন ২০ থেকে ২৫ টাকায়। মাঝখানের এই ১৫ টাকা ভাগ হয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীদের মধ্যে। এ ছাড়া প্রতি একর জমিতে কলা চাষে একজন কৃষকের খরচ হয় ৩৭ হাজার ৩৬৪ টাকা। ওই এক একর জমিতে কলা উৎপাদন হয় ১০ হাজার ৩২৭ মেট্রিক টন। আর ওই এক একরের ওপর যে পরিমাণ কলা উৎপাদিত হয়েছে তা বিক্রি করা হয়েছে এক লাখ ১৫ হাজার টাকায়।
জরিপে দেখা গেছে, একজন কৃষকের সাগর কলা চাষ করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ হয়। ওই কৃষক প্রতি একর জমিতে সাগর জাতের কলা চাষ করতে গিয়ে ৫৫ হাজার ৫৫৮ টাকা খরচ করেন। আর সেখান থেকে উৎপাদিত কলা বিক্রি করে আয় করেন সর্বোচ্চ এক লাখ ৫৮ হাজার টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খরচ হয় সবরি কলা চাষ করতে। প্রতি একরে এখানে খরচ হয় প্রায় ৪১ হাজার টাকা। আর এখান থেকে উৎপাদিত কলা বিক্রি হয় এক লাখ ৩৭ হাজার টাকা। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে কাঁচকলা।