একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প : সুদিন ফিরছে ২৪ লাখ পরিবারে

দুই বছর আগেও নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার পথে পথে ভিক্ষা করতেন আব্দুর রহিম। সেই পেশা ছেড়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি টি স্টল। ছয় মাস আগে গড়ে তুলেছেন একটি মুদি দোকান। আব্দুর রহিমের অভাব-অনটনের পরিবারে এখন সচ্ছলতা ও স্বাচ্ছন্দ্যের হাসি। এ জেলার সৈয়দপুর এবং জলঢাকায়ও এমন দিন বদলের গল্প মেলে।

আব্দুর রহিমের পরিবারের মতো গত তিন বছরে সুদিন ফিরতে শুরু করেছে দেশের ২৪ লাখেরও বেশি দরিদ্র পরিবারে। সরকারের ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে এ ধরনের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ। ৩ বছরে প্রকল্পের আওতায় এসেছে ৬৪ জেলার ঐ পরিবারগুলো। মত্স্য চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, গরু-ছাগল পালন, নার্সারি, সবজি বাগান, ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে দরিদ্র পরিবারগুলো গড়ে তুলছে স্থায়ী সঞ্চয়। এ জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ওয়ার্ডভিত্তিক ৪০ হাজার ৫২৭টি সমিতি। সমিতিতে সঞ্চয়ের অর্থ এবং সরকারের আর্থিক সহযোগিতা ব্যবহার করে দরিদ্র ব্যক্তিরা নিজস্ব ব্যবসায়ী কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করেছেন। এর ফলে স্থায়ীভাবে দারিদ্র্য বিমোচন শুরু হয়েছে। প্রথমত বাংলাদেশের কিছু এলাকা এ প্রকল্পে নেয়া হলেও এখন সারাদেশেই প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হচ্ছে।

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব এম এ কাদের সরকার বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুদ্রঋণ ও সর্বশেষ বাস্তবায়নাধীন প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন-প্রসূত একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছি। এগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, দারিদ্র্যমুক্ত মধ্যম আয়ের দেশ গড়তে ভারসাম্যহীন উন্নয়ন কর্মসূচি বন্ধ করে সমন্বিতভাবে দারিদ্র্যবিমোচনে প্রস্তাবিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। সকলে মিলে চেষ্টা করলেই সরকারের ভিশন-২০২১ অর্জন সম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় তিন বছর ধরে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ২৪ লক্ষের অধিক পরিবারের দারিদ্র্যবিমোচনে কাজ করছে। এ প্রকল্পের বিশেষ দর্শন হচ্ছে ‘ক্ষুদ্র ঋণ নয়, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে স্থায়ী দারিদ্র্যবিমোচন’।

একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের পরিচালক ড. প্রশান্ত রায় জানান, এ কর্মসূচির প্রথম লক্ষ্য  ব্যক্তি সঞ্চয় জমা, সরকার হতে প্রদত্ত বোনাস ও আবর্তক ঋণ তহবিলের সমন্বয়ে সমন্বিত তহবিল গঠন এবং উক্ত তহবিল বিনিয়োগের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়বর্ধক পারিবারিক খামার সৃষ্টি করে আত্মকর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, খাদ্য উত্পাদন বৃদ্ধি করা, পরিবারের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা ও দারিদ্র্য বিমোচন করা। এর মাধ্যমে দরিদ্র জনগণ অংশগ্রহণমূলক নিজস্ব ও স্থায়ী পুঁজি গঠন, উঠান বৈঠকের মাধ্যমে নিজেদের পেশা ও প্রয়োজনমত বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন। বিনিয়োগ শেষে সেবামূল্যসহ অর্থ নিজ সমিতির তহবিলে জমা হয়। এ জন্য ইতিমধ্যে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে।

গত সপ্তাহ পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ৩ বছরে ৩টি ধাপে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ মোট ২৪ লক্ষ পরিবারকে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পে সম্পৃক্ত করেছে। দেশের ৬৪ জেলার ৪৮৫টি উপজেলার ৪৫০৩টি ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠন করেছে। কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ৪০ হাজার ৫২৭টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতেই একটি করে সমিতি কাজ করছে। প্রতিটি সমিতি ৪০ জন মহিলা ও ২০ জন পুরুষ. মোট ৬০ সদস্য নিয়ে গঠিত। এ পর্যন্ত তাদের গড়ে ওঠা তহবিলের পরিমাণ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ তহবিলের মধ্যে বিনিয়োগ হয়েছে ১৩০০ কোটি টাকার উপর। বিনিয়োগকৃত অর্থে গড়ে উঠেছে ১২ লক্ষের অধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবিকাভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক খামার। সমিতির সদস্যরা নিজেরাই উঠান বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে- কে কোন বিষয়ে ঋণ নিবে এবং বিনিয়োগ করবে।

সঞ্চয় থেকে বিনিয়োগ: ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা মত্স্য চাষ, হাঁস-মুরগী পালন, গরু-ছাগল পালন, নার্সারী, সবজি বাগান, মুদি দোকান, টি স্টল কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করছেন। ইতিমধ্যে মোট সঞ্চয় থেকে বিনিয়োগকৃত অর্থে বিভিন্ন জেলায় ১২ লাখ ৩ হাজার ৫৩৫টি পরিবার স্থায়ী জীবিকায়নের পথে রয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৩২টি পরিবার মাছ চাষ, ৩ লাখ ১৯ হাজার ১৪০টি পরিবার হাঁস-মুরগী পালন, ৩ লাখ ২৩ হাজার ৫০৩টি পরিবার গরু-ছাগল পালন, ৭১ হাজার ৫৪০টি পরিবার নার্সারী এবং ২ লাখ ৩৭ হাজার ৮০০ পরিবার মুদি দোকান, রিক্সা-ভ্যান চালনা, টি স্টল, মুদি দোকান ও স্থানীয়ভাবে উপযোগী ক্ষুদ্র ব্যবসা বা কৃষি কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে।

অনলাইনে কার্যক্রম পরিচালনা: একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের যাবতীয় কার্যক্রম অনলাইনে পরিচালনা করা শুরু হয়েছে। ৪০ হাজার ৫২৭টি সমিতির মধ্যে ইতিমধ্যে ৩৯ হাজার ৬৫১টি সমিতি অনলাইনে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। একজন সদস্য মাসে ৫০ থেকে ২০০ টাকা সঞ্চয় জমা দেন অনলাইনে। সরকার সমপরিমাণ বোনাসও দেয় অনলাইনে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঋণ মঞ্জুর করেন অনলাইনে। এ সকল অর্থ জমা ও উত্তোলনের বিষয়টি নিশ্চিত হয় মোবাইল এসএমএস’র মাধ্যমে। এসএমএস দেখিয়ে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক বা সংশ্লিষ্ট মাধ্যম থেকে দরিদ্র সদস্য তার ঋণের অর্থ উত্তোলন করেন।

বিশেষায়িত কর্মসূচি: একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের অভিজ্ঞতার আলোকে ২০২০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্তির একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ। এরই অংশ হিসেবে নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ৭২০ জন ভিক্ষুককে ভিক্ষাবৃত্তি পরিত্যাগ করে জীবিকায়নের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে দারিদ্র্য বিমোচনে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় দুস্থ, ভিক্ষুক ও অতি গরীব সদস্যদের মাসে ২০০ টাকা সঞ্চয়ের অর্থ তাদের একাউন্টে জমা করা হয়। সঞ্চয়ের বিপরীতে বোনাস ও ঘূর্ণায়মান তহবিল প্রদান করা হয়েছে। এভাবে ৭২০ জন ভিক্ষুকের নিজস্ব সঞ্চয় ২ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ টাকা এবং সমাজসেবা হতে ১৫ লাখ ২ হাজার ৪০০  টাকা ভাতা প্রদান করা হয়। সঞ্চয় ও ভাতার অর্থের বিপরীতে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প হতে সমপরিমাণ অর্থাত্ ১৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা বোনাস ও ১৮ লাখ টাকা ঘূর্ণায়মান তহবিল প্রদান করা হয়। এর মাধ্যমে ঐ ৭২০ ভিক্ষুকের জন্য মোট ৫২ লাখ ৫৬ হাজার টাকার স্থায়ী তহবিল গঠন করে দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে এ তহবিল হতে তাদের প্রয়োজন ও ইচ্ছানুযায়ী ২৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ৪৬৪টি ছাগলের ও ১৩৫টি ক্ষুদ্র ব্যবসা (মুদিখানা, ফেরি করে বিক্রি, গ্রাম্য টি স্টল ইত্যাদি) মোট ৫৯৯টি পারিবারিক খামার বা আয়বর্ধক কাজ শুরু হয়েছে। কুষ্টিয়া জেলার খোকসা এবং মানিকগঞ্জের শিবালয়েও একই কাজ বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, সমন্বিত কর্মসূচির মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব। এ জন্য বাংলাদেশের সকল দরিদ্র লোককে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পভুক্ত করে কাজ করা যায়। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব ৬ মাস আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।