পদ্মা সেতু : নির্মাণযজ্ঞ দেখে দুঃখ শঙ্কা ভুলেছে মানুষ

পদ্মা সেতু প্রকল্পের কারণে নিজের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন। যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে ছিল শঙ্কা। গ্রামের এত দিনের পরিচিত মানুষগুলোকে ছেড়ে কোথায় বসতি গড়বেন তা নিয়েও ছিল অনিশ্চয়তা। কিন্তু একে একে সব শঙ্কা, অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে দাদন মিয়ার। বললেন, এখন বেশ সুখেই দিন কাটছে তাঁর। সেতু প্রকল্পের মাওয়া অংশে কুমারভোগ পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিজ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কালের কণ্ঠকে এমনটাই জানালেন ভূমি অধিগ্রহণের কারণে ভুক্তভোগী দাদন মিয়া।

আলাপচারিতায় দাদন মিয়া বলেন, ‘আমার ১৭ শতাংশ বসতবাড়ির পুরোটাই প্রকল্পের মধ্যে পড়েছে। ক্ষতিপূরণ হিসাবে আমাকে ৩০ লাখেরও বেশি টাকা দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পুনর্বাসন প্রকল্পে আমাকে সাড়ে ৭ শতাংশের একটি প্লট দেওয়া হয়েছে। সেখানেই বাড়ি বানিয়েছি। আশপাশে আমার অনেক প্রতিবেশীও প্লট পেয়েছে। আমরা এখন আগের মতো একই পাড়ার বাসিন্দা। আমরা সবাই খুশি।’

মাওয়াপারের দাদন মিয়ার মনে সন্দেহ ছিল নিজের প্রাপ্য নিয়ে। তেমনি দেশের অনেক মানুষের মধ্যেই প্রশ্ন ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে। প্রকল্প এলাকার মানুষের ত্যাগ আর সরকারের আপ্রাণ চেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে পদ্মা সেতুর কাজ। সেতু নির্মাণ নিয়ে এখন আর সন্দেহ, অনিশ্চয়তা নেই। নির্ধারিত সময় ২০১৮ সালের মধ্যেই সেতুর কাজ শেষ করতে দিন-রাত পরিশ্রম করছে সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যে পাঁচটি প্যাকেজে বাস্তবায়নাধীন পদ্মা সেতু প্রকল্পের সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্যাকেজের কাজ প্রায় এক-চতুর্থাংশ সম্পন্ন হয়েছে। সেতুর কাজ দৃশ্যমান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিকট ভবিষ্যতে নিজেদের এলাকার উন্নয়নও দেখতে পাচ্ছে প্রকল্প এলাকার মানুষ। মঙ্গল ও বুধবার সরেজমিনে মুন্সীগঞ্জ ও মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে স্থানীয় জনগণ ও নির্মাণসংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে এমনটা জানা গেছে।

পদ্মার ওপারে মাদারীপুরের শিবচরে বাখরেরকান্দি পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দা হারুন হাওলাদার। পুনর্বাসনকেন্দ্রে তিনি ও তাঁর ভাই একটি করে সাড়ে ৭ শতাংশের প্লট পেয়েছেন। আগে তাঁদের প্রায় তিন বিঘা জায়গা নিয়ে বসতবাড়ি ছিল। বাড়িতে নারিকেল, আম, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফলের গাছ ছিল। পুরোটাই পদ্মা সেতু প্রকল্পে অধিগ্রহণ করেছে সরকার। অধিগ্রহণের পর কয়েক বছর মনের মধ্যে দুঃখ বয়ে বেড়াচ্ছিলেন হারুন ও তাঁর পরিবার। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণ হচ্ছে দেখে পরিবারটির সদস্যদের দুঃখ উবে গেছে।

হারুনের স্ত্রী আছিয়া খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনেক বড় বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ছোট এ জায়টায় খুব কষ্ট হতো। এখানে গাছ নেই, গৃহপালিত পশু নেই, এগুলো ভেবে মন খারাপ হতো। কিন্তু এখন আর খারাপ লাগছে না। সেতুর কাজ চলছে। কয়েক বছরেই শেষ হবে। আমাদের ত্যাগের মধ্য দিয়ে এ এলাকার মানুষের অনেক বড় উপকার হচ্ছে ভেবে ভালোই লাগে।’ আছিয়ার মতো এমন কথা জানিয়েছে পাঁচটি পুনর্বাসনকেন্দ্রের অনেক বাসিন্দা।

সেতু প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাঁচটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে স্থান পাবে মোট দুই হাজার ৭০০ পরিবার। এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার এক শ প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকিদেরও শিগগির প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

মূল সেতুর দুই পাড়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ অনেকখানি শেষ হওয়ায় সেখানকার মানুষ নিজের এলাকার উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। পদ্মার ওপারে জাজিরা সংযোগ সড়কের শিবচরের এক গ্রামে দেখা গেল নির্মাণাধীন সড়কের এক পাশে ‘মোল্লাকান্দি বাসস্ট্যান্ড’ লিখে সাইনবোর্ড টাঙানো। বাস চলাচল নেই; কিন্তু বাসস্ট্যান্ড কেন জানতে চাইলে রফিক মোল্লা নামের স্থানীয় এক যুবক বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে এখান দিয়ে শত শত গাড়ি চলাচল করবে। এখানে একটি বাসস্ট্যান্ড তৈরি হলে এলাকার উন্নয়ন হবে। স্থানীয় মানুষের যাতায়াতে সুবিধা হবে। এসব বিষয় মাথায় রেখে স্থানীয়রা বাসস্ট্যান্ডের সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন। বলতে পারেন এটি আমাদের একটি দাবি।’

এগিয়ে চলেছে নির্মাণকাজ

যাবতীয় অনিশ্চয়তাকে পেছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে চলেছে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। পাঁচটি প্যাকেজের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজে যুক্ত আছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই তারা কাজ শেষ করতে পারবে। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের হিসাব অনুযায়ী বিদায়ী বছরের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে আর্থিক খাতে ৩০ শতাংশ ও ভৌত খাতে ১৬ শতাংশ। প্রকল্প পরিচালকের দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচটি প্যাকেজের মধ্যে জাজিরা সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ ইতিমধ্যে ২৯ শতাংশ শেষ হয়েছে। মাওয়া সংযোগ সড়কের কাজ ২২ শতাংশ শেষ হয়েছে। সার্ভিস এরিয়া-২ প্যাকেজের কাজ ১২ শতাংশ শেষ হয়েছে।

চলছে মূল সেতু নির্মাণ প্যাকেজের কাজও। এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘মূল সেতু নির্মাণের আগে আমাদের কিছু কাজ রয়েছে। এখন মাটি পরীক্ষা চলছে। পরে টেস্ট পাইলিং করতে হবে। ফেব্রুয়ারিতে আমরা টেস্ট পাইলিংয়ের কাজ শুরু করব। মূল পাইলিং কাজ শুরু করতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে। কারণ এর জন্য আড়াই হাজার টনের হ্যামার দরকার। জার্মানিতে এ হ্যামার নির্মাণের কাজ চলছে।’

মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, মুন্সীগঞ্জের মাওয়াঘাটের অদূরে মূল সেতুর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পানি লিমিটেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অফিস ও বাসস্থান নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ‘চায়না ভিলেজ’ নামে নির্মাণাধীন এলাকাটিতে এক হাজারের বেশি চীনা প্রকৌশলী থাকবেন বলে জানান পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম।

বুধবার জাজিরা সংযোগ সড়কে গিয়ে দেখা যায়, ২০টি কালভার্টের সব নির্মাণ শেষ হয়েছে। পাঁচটি সেতুর সবগুলোর কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। রাস্তা নির্মাণে মাটি ভরাটের কাজও শেষের দিকে।

সার্ভিস এরিয়া-২-এ গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্পের এ প্যাকেজের কাজও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। বিভিন্ন আকৃতির কটেজ ও ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। প্রতিদিন সেখানে তিন শিফটে কাজ হচ্ছে বলে জানান নির্মাণ শ্রমিক শফিক আলী।

সেতুর কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। পুনর্বাসনের কাজ মাঝপথে রয়েছে। পাঁচটি প্যাকেজের মধ্যে কোনোটির এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে।’ তিনি জানান, ‘এ পর্যন্ত প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।’ মোট ব্যয় ডলারের দাম বাড়লে কিছু বাড়তে পারে। এখনকার হিসাবে সেতুর জন্য মোট ব্যয় হবে ২৫ হাজার কোটি টাকা।’

পিছিয়ে আছে রেল

জানা গেছে, পদ্মা সেতুর ওপরের পথ দিয়ে গাড়ি এবং নিচের অংশ দিয়ে রেল চলাচল করবে। ২০১৮ সালে উভয় পথই যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু পাঁচটি প্যাকেজের বিভিন্ন অংশের কাজ বিভিন্ন মাত্রায় দৃশ্যমান হলেও পিছিয়ে রয়েছে রেলপথ নির্মাণের কাজ। এখনো রেল মন্ত্রণালয় ও পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের মধ্যেই রেলপথ নির্মাণের বিষয়টি সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। ঢাকা থেকে মাওয়া কিংবা নদীর ওপারে মাদারীপুরেও রেলপথ নির্মাণের বিষয়ে কোনো কাজ এখনো শুরু হয়নি।

এ বিষয়ে পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে রেলমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। এ বিষয়ে রেল মন্ত্রণালয় কাজ করছে।’

পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘রেলপথ নির্মাণের বিষয়ে আমরা রেল মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। এখন বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ ও মতামত বিনিময় হচ্ছে। এগুলো শেষ হলে রেলের বাস্তব কাজ শুরু হবে।’