চমক দেখাল চকরিয়ার মেয়েটি

আমার প্রথম স্কুল কক্সবাজারের চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠ। এখানেই মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছি। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুল বৃত্তি ছিল। এসএসসিতে পেয়েছি সব বিষয়ে জিপিএ ৫। বেসরকারি অনেক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথম হয়েছি। এসএসসির পর ভর্তি হই চট্টগ্রাম কলেজে। ২০১৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিই, সেখানে সব বিষয়ে জিপিএ ৫। একই বছর মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েও ভর্তির সুযোগ পাইনি। দমে না গিয়ে শুরু করি নতুন করে প্রস্তুতি। ফলও মিলেছে। ২০১৪ সালের মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় সারা দেশে প্রথম হয়েছি। ভর্তি পরীক্ষায় আমার প্রাপ্ত নম্বর ৮১ দশমিক ৫০।

প্রথমবার চান্স না পাওয়ায় ভীষণ জেদ চেপেছিল দ্বিতীয়বার আমাকে পারতেই হবে। কখনোই ভাবিনি প্রথম হব। এর জন্য আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। কলেজ হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছি। পরীক্ষার দুই মাস আগে থেকে সঙ্গে ছিলেন মা। আব্বু প্রতিক্ষণ খোঁজ নিতেন। শিক্ষক, সহপাঠী, শুভাকাঙ্ক্ষীদের আন্তরিক সহায়তাও ছিল। শিক্ষকদের অবদান সবচেয়ে বেশি। হোস্টেলে চার বন্ধু একসঙ্গে থাকতাম। একসঙ্গে প্রস্তুতি নিতাম, পড়ার বিষয়ে একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করতাম। এটা কাজে দিয়েছে।

যা-ই পড়তাম, দাগিয়ে পড়তাম, টিক মার্ক দিয়ে রাখতাম। মনে রাখার জন্য ছন্দ মিলিয়ে পড়তাম। যেহেতু মেডিক্যাল পরীক্ষা এমসিকিউতে হয়, সে জন্য ছক ভালো করে দেখতাম। বৈজ্ঞানিক নাম ভালো করে দেখতাম। প্রথমে পাঠ্য বই ভালো করে আয়ত্তে করে নিয়েছিলাম। পাশাপাশি নিজে কিছু নোট করে রাখতাম। যাতে পরীক্ষা সামনে চলে এলে ঠিক সময়ে চোখ বুলিয়ে নিতে পারি। পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে ছয়টি বিষয়ের জন্য এক দিন করে বরাদ্দ রেখেছিলাম। বন্ধুদের অনেকের ভাবনা ছিল, ৭০ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র চার হাজার টিকবে। সেখানে কিভাবে ঠাঁই পাওয়া যাবে! আমি তা ভাবতাম না। বিশ্বাস ছিল, পরীক্ষায় ভালো করতে পারলে সফলতা আসবেই।

আমার বাবা এস এম কামাল উদ্দিন স্কুল শিক্ষক, মা সুলতানা রাজিয়া গৃহিণী। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে আমি দ্বিতীয়। বড় বোন সাদিয়া সুলতানা নিশাত চট্টগ্রামে উদ্ভিদবিজ্ঞানে পড়ছেন। ছোটভাই জয়নুল আবেদীন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র। পরীক্ষার আগে সবাই প্রেরণা দিয়েছে।

মফস্বলে থাকার কারণে অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হয়েছি। আমার স্কুলে ল্যাব ছিল না। তাই ছিল না ব্যবহারিক ক্লাসের সুযোগ। বইয়ের পাতায় ছবি দেখে বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো আয়ত্তে নেওয়ার চেষ্টা করতাম। গ্যাপ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাটা পরবর্তী সময়েও ছিল। মফস্বল এলাকায় সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার প্রসঙ্গ এলে আব্বু বলতেন, ‘আমরা মাটিতে বসে পড়েছি। তোমরা এখন টেবিলে বসে পড়ছ। তাহলে কেন ভালো করবে না।’

ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হব। সে জন্য নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগ নিই। জীববিজ্ঞানে ছিলাম দারুণ মনোযোগী। এটাই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় ক্লাসরুমে একজন শিক্ষক একটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছিলেন। উত্তর দিতে দেরি হওয়ায় স্যার অনেক বকাঝকা করেছিলেন। বকা খেয়ে সেদিন অনেক কান্নাকাটি করেছিলাম। ছোট্ট এ ঘটনা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। যা পড়তাম ভাসাভাসা পড়তাম না। পুরো ধারণা নিয়ে একদম আত্মস্থ করে ফেলতাম। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় এ চর্চা দারুণ কাজে দিয়েছে।

চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময় কলেজের শিক্ষকদের উপদেশ ও পরামর্শ পেয়েছি। তবে আমার শিক্ষাজীবনের মূল ভিত্তিটা তৈরি হয় চকরিয়ার কোরক বিদ্যাপীঠে। সেখানে অনেক ভালো শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি। তেমনিভাবে গুটিকয়েক শিক্ষক আমার ওপর বিরূপ ছিলেন। এক শিক্ষক অযথা আমার ওপর রাগ করতেন। পরীক্ষার খাতায় তুলনামূলক কম নম্বর দিতেন। কারণ ওই শিক্ষকের কাছে আমি প্রাইভেট পড়তাম না। ওই সময় মনস্থির করেছিলাম, পরীক্ষার খাতায় এত ভালো লিখতে হবে, যাতে কোনোভাবেই তিনি নম্বর কম না দিতে পারেন। ওই শিক্ষক যদি এত সব কাণ্ড না করতেন, তাহলে আমি হয়তো পড়াশোনায় তেমন মনোনিবেশ করতাম না।

ছোটকাল থেকেই ছিলাম একরোখা ও জেদি স্বভাবের। কৈশোরের একটি ঘটনা এখনো আমাকে হাসায়। তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। একবার নানুবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার অভ্যাস ছিল নানুবাড়ি গেলেই বাড়ির পাশের লিচুগাছটায় চড়ে বসা। ওই দিনও যথারীতি গাছটায় উঠতে যাব, অমনি মায়ের বারণ! কিন্তু কে শোনে কার কথা! উঠে বসলাম গাছে। এ ডাল থেকে ও ডাল। হঠাৎ আমার ফ্রক আটকে গেল ডালে। পিছলে গিয়ে গাছের ডালে বানরের মতো ঝুলছি আর হাত-পা ছুড়ছি। মা এসে উদ্ধার না করলে সেদিন কী যে হতো!

জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় অনেকে প্রথমবার আবার কেউ দ্বিতীয়বার কৃতকার্য হয়। কিন্তু দ্বিতীয়বার কেন পরীক্ষা দিতে হয়েছে, কেনই বা প্রথমবার কৃতকার্য হলাম না-এ ধরনের নানা সংশয় কাজ করে সবার মধ্যে। অনুজদের প্রতি আমার পরামর্শ-বছরের শুরু থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। পরীক্ষায় দ্বিতীয়বার অংশ নেওয়ার আগে ভাবতে হবে, প্রথমবার কেন খারাপ করেছি। অনেক সময় পড়তে অস্বস্তি লাগে-এটা মাথা থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলতে হবে। কোনো অবস্থায়ই হতাশ হওয়া যাবে না।

এইচএসসি লেভেলের পাঠ্য বইগুলো খুব ভালোভাবে আয়ত্তে নিতে হবে। প্রাণিবিজ্ঞানে গাজী আজমল, নাসিম বানুর বই, উদ্ভিদবিজ্ঞানে আবুল হাসান আর গাজী আজমলের বই, পদার্থবিজ্ঞানে আমির ইসহাক ও তফাজ্জল হোসেনের বই, রসায়নের জন্য হাজারী নাগ ও কবির স্যারের বই বেশি কাজের। একটি বিষয়ে একাধিক লেখকের বই পড়তে পারো। একজন লেখকের বই অনুসরণ করলে অন্য সব বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট টুকে নিতে হবে। ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞানের জন্য বিগত বছরের মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন দেখে প্রস্তুতি নিতে হবে।

এখন বেশ অবসর। টিভি দেখা, মায়ের সঙ্গে রান্নাবান্নার কাজে সহযোগিতা করে সময় কাটে। অবসরে গল্পের বই পড়েও সময় কাটাই। প্রতিদিন কোনো না কোনো স্বজনের বাড়িতে দাওয়াত খাচ্ছি এবং ঘুরে বেড়াচ্ছি। ক্লাস শুরু হয়ে গেলে অবশ্য সেই সুযোগ থাকবে না। এখন পড়াশোনা নিয়ে আমার যত ভাবনা। বড় হয়ে কার্ডিওলজিস্ট হতে চাই। কোনো দিন যদি সামর্থ্য হয়, একটি দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে তুলব, গ্রামের মানুষরা বিনা খরচে চিকিৎসা পাবে সেখানে।