দুঃসময়েও এগিয়ে নারীরা

২০০৭ সালে রফতানির ২ দশমিক ২৯ ভাগ ছিল নারী কর্মী। সাত বছর পর এই হার এখন ১৭ দশমিক ৮৮ ভাগ।

রাজীব আহাম্মদ

জনশক্তি রফতানির মন্দার সময়েও এগিয়ে যাচ্ছে নারী। জনশক্তির সামগ্রিক রফতানি নিম্নমুখী হলেও নারী কর্মী রফতানিতে এগিয়েছে বাংলাদেশ। ২০০১ সাল থেকে প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে নারী শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়ার হার। ১৯৯১ সালে নারী কর্মীদের বিদেশে কাজ করতে যাওয়া শুরু হলেও ২০০৭ সালে মোট রফতানির মাত্র ২ দশমিক ২৯ ভাগ ছিল নারী কর্মী। সাত বছর পর এই হার এখন ১৭ দশমিক ৮৮ ভাগ। রেমিট্যান্স আয়ের প্রায় ১৫ ভাগ নারীর অবদান।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো-বিএমইটির হিসা অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত কাজ নিয়ে বিদেশ গেছেন ৬০ হাজার ৬৯১ জন নারী শ্রমিক। ২০১৩ সালে পুরো বছরে ৫৬ হাজার ৪০ জন যান। ২০১২ সালে ৩৭ হাজার ৩০৪ জন, ২০১১ সালে ৩০ হাজার ৫৭৯ জন। ২০০১ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৫৪। ১৩ বছরে ১৬০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে নারী কর্মী রফতানি। ২০০১ সালে নারী-পুরুষ মিলিয়ে সর্বমোট জনশক্তি রফতানি হয়েছিল এক লাখ ৮৮ হাজার ৯৬৫ জন।

চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত কাজ নিয়ে বিদেশ গেছেন তিন লাখ ৩৭১ জন। অর্থাৎ সামগ্রিক রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ২ দশমিক ১৫ গুণ আর নারী শ্রমিক রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে ১৬০ গুণ। রেমিট্যান্স আয়ের ১৫ ভাগ অর্থাৎ বছরে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন প্রবাসী নারী কর্মীরা।

বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় নারীর বিদেশে কাজ করতে যাওয়াকে ভালো চোখে দেখা হয় না। প্রতি পদে রয়েছে বাধা। এ বাধা অতিক্রম করে বিদেশে কাজ করতে যাওয়াকে নারীর জয় বলেই মনে করেন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি রিসার্চ ইউনিট-রামরু’র সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিআর আবরার। তিনি সমকালকে বলেন, পুরুষের জন্য বিদেশে কাজ করতে যাওয়া যতটা কঠিন, নারীর জন্য তা আরও কঠিন। তারপরও নারীরা পুরুষের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। একে নারীর জয় বলতেই হবে।

বাংলাদেশের কর্মীদের বিরুদ্ধে বিদেশে গিয়ে হত্যা, ডাকাতির মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন দেশের কারাগারে বিভিন্ন অভিযোগে আটক আছেন ৪ হাজার ৫৪৬ জন। শুধু আরব আমিরাতের কারাগারেই আটক রয়েছেন এক হাজার ১৯ জন বাংলাদেশি। এদের মধ্যে ২৩ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। পুরুষ কর্মীদের তুলনায় এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নারী কর্মীরা। এখন পর্যন্ত কোনো নারী কর্মীর বিরুদ্ধে কোনো দেশেই ফৌজদারি অপরাধের কোনো অভিযোগ ওঠেনি। আরব আমিরাতে বর্তমানে ৮৮ হাজার ৫৮৯ নারী কর্মী কাজ করছেন।

বিএমইটির মহাপরিচালক বেগম শামসুন নাহার সমকালকে বলেন, পরিসংখ্যানই নারীর এগিয়ে যাওয়ার প্রমাণ। প্রতি বছরই বাড়ছে নারী শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়া। মেয়েদের বিদেশের অচেনা পরিবেশে কাজ করা কঠিন হলেও বাংলাদেশের নারীরা প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। গৃহকর্মী ছাড়াও পোশাকশিল্পে নারীদের কাজ করার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে এই বাজার দখল করা সম্ভব।

নারী এগিয়ে গেলেও বিদেশে পুরনো হয়রানি এখনও রয়ে গেছে। শারীরিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, বেতন-ভাতা না দেওয়াসহ বছরে অন্তত ৪০০ অভিযোগ এসেছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড’-এর কাছে। প্রবাসী কল্যাণ সচিব ড. খন্দকার শওকত হোসেন সমকালকে বলেন, পুরুষ শ্রমিকদের মতো নারী শ্রমিকদেরও ন্যায্য পারিশ্রমিক না দেওয়ার কিছু অভিযোগ আসে। মন্ত্রণালয় যথাসম্ভব চেষ্টা করে পাওনা আদায় করে দিতে। সচিব জানান, যৌন নিপীড়নের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমেছে। নারী কর্মীদের জন্য প্রবাসে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। এ বিষয়টিকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কর্মপরিবেশ শতভাগ নিরাপদ করা গেলে নারী কর্মীদের বিদেশ যাওয়ার হার আরও বাড়বে।

চলতি সপ্তাহে সরেজমিন ইস্কাটনের প্রবাসীকল্যাণ ভবন এলাকা ঘুরে দেখা যায় পুরুষের পাশাপাশি বিদেশে কাজ করতে যেতে ইচ্ছুক নারীদের ভিড়। কেউ এসেছেন নিবন্ধন করতে, আবার কেউ এসেছেন স্মার্ট কার্ড নিতে। কেউবা এসেছেন বিদেশ যাওয়ার আগে নিয়ম-কানুন শেখার ব্রিফিং শুনতে। শুধু শহুরে এলাকার নয়, প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরাও রয়েছেন তাদের দলে।

তাদেরই একজন ময়মনসিংহের ভালুকার উথুরা গ্রামের শামিম আরা জুঁই। বাবা মারা গেছেন। ভাইয়েরা বয়সে ছোট। ২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করায় পড়াশোনা করা হয়নি। সে জন্য দেশে কোনো চাকরিও পাচ্ছেন না। নিজের বাড়ির সব কাজ করেই দিন পার। চেষ্টা করছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়ার।

বিদেশ গিয়ে কী করবেন- জানতে চাইলে এই তরুণী বললেন,’দেশে যা করি তা-ই করব। বাড়ি-ঘরের কাজ করব।’ তাহলে দেশ ছেড়ে বিদেশ কেন? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দেশে অন্যের বাড়িতে কাজ করলে মানুষে ‘বুয়া’ ডাকে। তার চেয়ে বিদেশ গিয়ে করব। কেউ বুয়া ডাকবে না, টাকাও বেশি; সম্মানও আছে। জুঁই জানালেন, প্রথমে তার মা বিদেশে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না। অনেক বোঝানোর পর রাজি হয়েছেন। সমিতিতে জমানো এক লাখ ৮০ হাজার টাকাও দিয়েছেন। বিদেশে টাকা উপার্জন করে ছোট দুই ভাইকে ভালোভাবে পড়াশোনা করাতে চান তিনি।

প্রায় ৩৫ বছর বয়সী খোদেজা বেগমের বাড়ি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে চা বাগান গ্রামে। কাজ করেন গার্মেন্টে। তিনি যেতে চান মরিশাসে। সেখানেও গার্মেন্টসের কাজ করবেন। তাহলে পরিবার-পরিজন ফেলে কেন বিদেশ যেতে চান- এ প্রশ্নে খোদেজা জানালেন, টঙ্গীতে যে গার্মেন্টসে কাজ করেন যেখানে সব মিলিয়ে মাসে মাত্র সাত হাজার টাকা পান। এই টাকায় তিন সন্তান নিয়ে সংসার চলে না। দুই লাখ টাকা খরচ করে মরিশাসে যেতে পারলে একই কাজ করে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব। দেশে মেয়েদের কাজ করতে বিদেশ যাওয়াকে ভালো চোখে দেখা না হলেও যেতে চান খোদেজা। তিনি বলেন, কে কী বলল, কিছু যায় আসে না। আমার তিন বাচ্চার খাওয়া আমাকেই জোগাড় করতে হয়।

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ার পর বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার ওমান, কাতার, সিঙ্গাপুর, বাহরাইন, জর্ডান ও লেবানন। জর্ডান ও লেবাবননে পুরুষের চেয়ে এগিয়ে আছে নারী। চলতি বছর জর্ডানে গিয়েছেন ১৭ হাজার ২৪৭ জন বাংলাদেশি শ্রমিক, যার মধ্যে ১৭ হাজার ২০ জনই নারী। লেবাননে যাওয়া ১২ হাজার ৫৬৪ জন বাংলাদেশি কর্মীর মধ্যে ৯ হাজার ৩৬১ জনই নারী।

আরব আমিরাতের বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য নারীদের। চলতি বছরে যাওয়া ১৯ হাজার ৩৯২ জন বাংলাদেশি কর্মীর ১৮ হাজার ৪৭৮ জনই নারী। গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর আরব আমিরাত সফরে নারী শ্রমিকদের জন্য দেশটিতে প্রবেশের দ্বার অবারিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী মাসে অন্তত এক হাজার নারী কর্র্মী দেশটিতে যাবেন বাংলাদেশ থেকে।

বর্তমান প্রধান দুই রফতানি ক্ষেত্র ওমান ও কাতারেও পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরা যাচ্ছেন উল্লেখযোগ্য হারে। চলতি বছরে ওমানে যাওয়া ৮৮ হাজার ২২২ জনের মধ্যে ৯ হাজার ২৩৪ জন নারী। কাতারে যাওয়া ৬৯ হাজার ২৬৬ জনের মধ্যে চার হাজার ৯৭৪ জন নারী।