পাহাড়ের গায়ে কমলার রাজত্ব

যতদূর চোখ যায়, পাহাড়ের গায়ে থরে থরে সাজানো শুধু কমলার বাগান। গাঢ় সবুজ পাতার আড়ালে কাঁচা-পাকা কমলার উঁকিঝুঁকি। পাহাড় আর টিলাগুলো যেন সেজেছে সোনালী বুটিতোলা পান্না-সবুজ রঙের শাড়িতে। এখন মৌলভীবাজার জেলার জুড়ি উপজেলার গোয়ালবাড়ি ইউনিয়নের লাল ছড়া, কচুরগুল, হাওয়াছড়া, রূপাছড়া, বেলাবাড়ী, লাটিঠিলা, লাটিছড়া, কালাছড়া, লালছড়া, জরছড়া, শুকনাছড়া, ডোমাবাড়ি, জামকান্দি, ছোট ধামাই, জায়ফরনগর ও পার্শ্ববর্তী কুলাউড়া ও বড়লেখায় গেলে কমলা বাগানের এই দৃশ্য সবার মন কেড়ে নেবে।
প্রায় ৫ হাজার হেক্টর পরিত্যক্ত পাহাড়ি জমিতে দুই উপজেলায় রয়েছে ৫ শতাধিক কমলা বাগান। স্থানীয় উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জুড়ি উপজেলায় ৬২ হেক্টেরে ৫১ হাজার ৪শ ৬০টি গাছ ও চারা পরিচর্যা করছেন চাষিরা। আর বসত বাড়িতে ২৬ হেক্টরে ২৩ হাজার ২শ ৯০টি গাছ ও চারা পরিচর্যা হচ্ছে। গোয়ালবাড়ি ইউনিয়নে ৫৩ হেক্টরে বাগান রয়েছে ৪২টি, ছোটধামায়ে ৫টি, জাফরনগরে ১টি। এ সকল বাগান থেকে চাষিরা বছরান্তে কোটি টাকার কমলা বিক্রি করে থাকেন। এখন কমলার ভরা মৌসুম। কমলার ঘ্রাণে ম-ম করছে গোটা এলাকা।
এবছর চাষিদের মুখে ফুটেছে হাসি। কারণ, গত কয়েক বছরের চাইতে এ বছর ভালো ফলন হয়েছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, রোগ বালাইসহ নানা কারণে গত কয়েক বছর আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়নি। এবার মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টি হওয়ায় ফলন ভালো হয়েছে। এমন কথাই জানালেন, রূপাছড়ার চাষি আব্বাস আলী, লালছড়ার ফখর উদ্দিন, লাটিছড়ার আব্দুল কাইয়ুম, লালছড়ার রহিমা বেগম, মুরশেদ মিয়া মো. জুয়েল আহমদ ও আবু তাহের। এখন ভরা মৌসুম তাই সকাল থেকেই বাগান পরির্চযা আর কমলা সংগ্রহে ব্যস্ত চাষিরা। বাড়ির সবাই মিলে গাছ থেকে কমলা পেড়ে আনা, বাছাই শেষে ঝুড়ি ভর্তি করা–এসব করছে দিনভর। কমলাভর্তি ঝুড়িগুলো স্থানীয় দিলকুশ বাজারে কিংবা বাড়িতে আসা পাইকারদের কাছেই বিক্রি করা হয়।
চাষিরা জানালেন, কমলার সাইজ অনুযায়ী তারা একহালি কমলা ১৫ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন। অগ্রহায়ণ মাসই কমলা পুরোপুরি পাকার সময়। এখন কিছু কিছু পাকলেও বেশিরভাগই কাঁচা। কাঁচা কমলা তারা বিক্রি করে দিচ্ছেন অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধেই। তার কারণ হিসাবে কৃষকরা জানালেন, আর কিছুদিন গেলে নাকি ভারত ও চীন থেকে আমদানি করা কমলায় বাজার সয়লাব হয়ে যাবে। তখন কমলার দাম পড়ে যায়। তাই দাম পেতে এখন তড়িঘড়ি কাঁচা কমলাই বিক্রি করে দিতে হচ্ছে তাদের। সেকেলে পদ্ধতির চাষাবাদের কারণে তাদের কমলার আকার, রঙ ভালো হয় না। শুধু একারণেই তাদের কমলা আর্ন্তজাতিক বাজারেও রফতানি করা যায় না। গান্ধী পোকা ও পাতা হলদে হয়ে গাছ মরে যাওয়া রোগসহ প্রতিবছরই তাদের নানা সমস্যা পোহাতে হয়। অনেক নতুন রোগ সম্পর্কে স্থানীয় কৃষি বিভাগও জানে না, তাই তারা কোন সমাধানও দিতে পারে না। তাই চোখের সামনেই ধীরে ধীরে ফলন দেয়া গাছ মরে যায়। সবসময় কৃষি বিভাগের লোকদের পাওয়াও যায় না। তারা সরজমিনে আসেন না–এমন অভিযোগও রয়েছে অনেক চাষির। এমন অভিযোগ মানতে নারাজ স্থানীয় কৃষি বিভাগের লোকজন। তারা জানালেন, লোকবল সংকটের মধ্যেও তারা চাষিদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। কমলা চাষিরা জানান, তারা খাস জমিতে বসবাস করেন বলে কোন ব্যাংক বা সংস্থা থেকে ঋণ সহায়তা পান না। তাই আর্থিক সংকট থাকার কারণে চাষিরা ফলন আসার আগেই এক বা দুই বছরের জন্য তাদের বাগান বা বসত বাড়ির গাছ কম মূল্যে আগাম বিক্রি করে দেন পাইকারদের কাছে। এতে বিরাট আর্থিক ক্ষতি হয় তাদের। লাভবান হন ফড়িয়া ও দালালরা। তাছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় এবং কমলা বিক্রির জন্য নির্দিষ্ট বড় বাজার না থাকায় তারা প্রতিবছরই এ ক্ষতির শিকার হন। সিলেট অঞ্চলের কমলার কদর দেশের র্সবত্রই- তাই এখনাকার কমলার চাহিদাও ব্যাপক এমনটি জানালেন, শরিফ উদ্দিন ও হামিদ মিয়া নামের দুই পাইকার। এখানকার কমলা গাড়ি বোঝাই হয়ে দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছায়।