বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার নতুন ঋণ দিচ্ছে ভারত

আঞ্চলিক যোগাযোগ বা কানেকটিভিটির জন্য বাংলাদেশকে নতুন করে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিতে পারে ভারত। বিষয়টি দিল্লি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে বলে ঢাকায় কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি দিল্লি সফরে গিয়ে জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশন (জেসিসি) বৈঠকে এই নতুন ঋণের প্রস্তাব রাখে।

নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকের পর মোদি এক টুইটার বার্তায় বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তার প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন। তবে কী পরিমাণ সহায়তা দেয়া হবে সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি।

ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশকে আঞ্চলিক কানেকটিভিটির উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তুলতে অবকাঠামো খাতে কমপক্ষে এক হাজার চারশ কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। এই পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এই খাত বিদেশী বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে। এই খাতে ভারত, চীন ও জাপানের সহায়তা মিলবে বলে আশা করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা ২০১০ সালে ভারত সফরে গেলে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার ঘোষণা দেন। পরে ওই ঋণের ২০ কোটি ডলার মঞ্জুরি ঘোষণা করে ভারত। অবশিষ্ট ৮০ কোটি ডলার ঋণ হিসেবে থেকে যায়। দিল্লিতে সর্বশেষ জেসিসি বৈঠকের পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমানে এই ঋণের মধ্যে ৭৫ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার ডলারের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে এই ঋণের অবদানকে বাংলাদেশ পক্ষ স্বাগত জানিয়েছে এবং প্রস্তাবিত দ্বিতীয় ১০০ কোটি ডলার ঋণের জন্য ভারতের ইতিবাচক সাড়া কামনা করেছে। জেসিসি বৈঠকের ফলোআপ হিসেবে হাসিনা-মোদি বৈঠকে এই ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া মিলেছে। দুদেশের শীর্ষ পর্যায়ে সফরকালে নতুন ঋণের ঘোষণা পাওয়ার ব্যাপারে ঢাকার কর্মকর্তারা আশাবাদ ব্যক্ত করছেন।

ভারতের প্রথম ঋণের অর্থ অবকাঠামো উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিট চাইছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ট্রানজিটের বিষয়ে বাংলাদেশের নীতিগত কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বড় বাধা হল পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকা। ফলে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট পেতে ভারতকেই অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে।

এদিকে, মোদির সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর প্রতি অধিক জোর দিচ্ছে ভারত। ভারতের বেসরকারি খাতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আগ্রহের কথা বলা হচ্ছে। এই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের লক্ষ্যে ভারতের জন্যই পৃথক শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে জায়গা দিতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ। ফলে বিনিয়োগে অবকাঠামো উন্নয়নের প্রশ্নটি সামনে চলে আসছে। সড়ক, রেল, নৌ ও জাহাজ পথের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প সামনে আসছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কানেকটিভিটি বাড়াতে আগামী মাসে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হতে পারে ঢাকা-শিলং-গৌহাটি বাস সার্ভিস এবং উপকূলীয় জাহাজ চলাচল। এছাড়াও চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারসহ কমপক্ষে ১৫টি রুটে ট্রানজিট চাইছে ভারত। এ রুটগুলো হল- আখাউড়া-আগরতলা, সাবরুম-রামগড়, দেমাগিরি-তেগামুখ, বিবিরবাজার-শ্রীমান্তপুর, বিলুনিয়া-বিলুনিয়া, বেতুলি-রাংনা বাজার, চাতলাপুর-মনু, তামাবিল-ডাউকি, বরসরা-বরসরা, হালুয়াঘাট-ঘসুয়াপাড়া, সুনামগঞ্জ-শেলবাজার, দর্শনা-গেদে, রোহনপুর-সিঙ্গাবাদ, বিরল-রাধিকাপুর, বেনাপোল-পেট্রাপোল। ভারত এই রুটগুলোর সঙ্গে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরের সংযোগ সৃষ্টি করে ব্যাপক ট্রানজিট চাইছে। ভারতের নতুন ঋণ পাওয়া গেলে এসব রুটে কানেকটিভিটির ক্ষেত্রে প্রয়োজন মোতাবেক নতুন সড়ক কিংবা রেলপথ নির্মাণ, বিদ্যমান রাস্তার সংস্কার কিংবা মেরামত, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ এবং নৌপথের নাব্যতা ও অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করা হবে।

আঞ্চলিক কানেকটিভিটি ও পরিবহন ব্যবস্থা : ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে উপাঞ্চলিক এবং আঞ্চলিক কানেকটিভিটির জন্যও বাংলাদেশকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার বিষয়ে সরকারের ভেতর ও বাইরে আলোচনা হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু, যমুনা নদীর ওপর পৃথক রেল সেতু, রাজধানীর চারপাশের নদীপথের সংস্কার এবং বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয়ে আলোচনা চলছে।

কানেকটিভিটির জন্য আঞ্চলিক উদ্যোগের মধ্যে আছে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান নিয়ে উপাঞ্চলিক সহযোগিতা, চীনের উদ্যোগে বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমারের মধ্যে বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর, সার্কের আওতায় প্রস্তাবিত মটরযান চুক্তি, চীনের উদ্যোগে সামুদ্রিক সিল্ক রুট, জাপানের উদ্যোগে বিগ-বি নামের বঙ্গোপসাগরীয় শিল্পাঞ্চল এবং ভারতের উদ্যোগে বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমারের মধ্যে ত্রিদেশীয় বঙ্গোপসাগরীয় সহযোগিতা। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে বিদেশী বিনিয়োগ চায় বাংলাদেশ।

আঞ্চলিক কানেকটিভিটির জন্য বাংলাদেশের ভেতরের অবকাঠামোর উন্নয়নে বিনিয়োগের অর্থ পাওয়াই যখন বড় সংকট, তখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা বলছেন, অর্থ কোনো সংকট নয়। তিনি কূটনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ডিকাবের অনুষ্ঠানে প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, দুর্নীতি মোকাবেলা সম্ভব হলে বেসরকারি খাতে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাই বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন।