আইপি ক্যামেরায় সড়ক মহাসড়কে নজরদারি ॥

জ্বালাও পোড়াও আর বেপরোয়া গাড়ি চালালে রক্ষা নেই

যত্রতত্র গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে দীর্ঘ যানজট। বাস থামিয়ে লোক উঠানো। গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে রাস্তায় পড়ে থাকা। পুলিশের কর্তব্যে অবহেলা। পরিবহন চাঁদাবাজি। ছিনতাই। অজ্ঞান ও মলম পার্টির দৌরাত্ম্য যে কোন ধরনের অপরাধ ঘটানো কিংবা সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে চলে যাওয়ার দিন একেবারেই শেষ। হরতাল অবরোধে গাড়িতে মানুষ পুড়িয়ে মারা বা সহিংস পিকেটিং বা ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচী পালনে এখন থেকেই সাবধান হতে হবে। অবাক করার মতো বিষয়। হঠাৎ করে আবার কী হলো। অনেকের কাছে আশ্চর্য মনে হচ্ছে। সড়কে কিভাবে এসব প্রতিরোধ করা সম্ভব। পরিষ্কার করে বললে, মহাসড়কে যা ঘটবে তাই দেখা যাবে টিভি ও মোবাইল মনিটরে। দেখা মাত্রই নেয়া হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।

মহাসড়ক আরও নিরাপদ করতেই নিবিড়ভাবে এ ধরনের নজরদারির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে বুধবার দুপুর থেকে। সুইচ টিপে ঢাকা জেলা পুলিশের উদ্যোগে আশুলিয়ার বাইপাইল পুলিশ বক্সে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছেন পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার। ঈদে ও পুজোয় ঘরমুখো মানুষের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আমিনবাজার, সাভার বাসস্ট্যান্ড, নবীনগর, ধামরাই থানার ইসলামপুর এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের আশুলিয়া, বাইপাইল, কবীরপুর ও চন্দ্রায় বসানো হয়েছে আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) ক্যামেরা। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার মতোই নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকা এসব ক্যামেরার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যেখানেই থাকুন না কেন অফিসে বসে কিংবা চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোনেই দেখতে পাবেন সড়কের পরিস্থিতি।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলোর মধ্যে চন্দ্রা-আশুলিয়া বাইপাইল পয়েন্ট অন্যতম। উত্তরাঞ্চলসহ ৩০টির বেশি জেলার যানবাহন এই সড়কপথটি ব্যবহার করে। যানজটের বিষফোঁড়া হিসেবে খ্যাত পুরো শিল্পাঞ্চল এলাকা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রীদের বসে থাকার নজির দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে ঈদ মৌসুমে রাস্তাটিতে ভোগান্তির যেন শেষ নেই। নানামুখী অপরাধ তো আছেই। ইতোমধ্যে ভোগান্তি নিরসনে এই এলাকার রাস্তা প্রশস্ত করা হয়েছে। আসন্ন ঈদে জনদুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে নেয়া সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ঈদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আয়োজিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বিষয়টি প্রথমবারের মতো উঠে আসে।

কমিউনিটি পুলিশের অংশ হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সহায়তায় এ কাজটি বাস্তবায়ন করেছেন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) হাবিবুর রহমান। তিনি জানান, ঢাকা আরিচা মহাসড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এ উদ্যোগ। পরীক্ষামূলকভাবে এ উদ্যোগে আমরা সাড়া পাচ্ছি। আইজিপি আজ (বুধবার) আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করায় এ কার্যক্রম আরও গতি লাভ করবে বলেও জানান তিনি। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় নেয়া এ উদ্যোগের সুফল জনগণ ভালভাবেই উপভোগ করবে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি জানান, ইন্টারনেট প্রটোকল ক্যামেরার মাধ্যমে অন লাইনেই পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে বসে পর্যবেক্ষণ করা যাবে সড়কের সার্বিক পরিস্থিতি।

এ উদ্যোগ সম্প্রসারণ করতে ইতোমধ্যে মানিকগঞ্জের প্রবেশ সীমানা অর্থাৎ ঢাকা জেলার শেষ সীমানা ধামরাইয়ের বারোবাড়িয়ায় ক্যামেরা স্থাপনের কাজ চলছে। একটি নির্দিষ্ট সাইটে ঢুকে নির্দিষ্ট পাসওয়ার্ড দিয়ে থানা, পুলিশ বক্স কিংবা পুলিশ সুপারের কার্যালয় সবখানেই স্থাপিত মনিটরে দেখা যাবে সড়কের হাল আর এই কার্যাক্রম নিয়ন্ত্রণ করা হবে কেন্দ্রীয়ভাবেই। এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার জানান, সড়কে নিরাপত্তার পাশাপাশি কেউ জ্বালাও পোড়াওয়ের কিংবা গাড়ি ভাংচুরের মতো ফৌজদারি অপরাধ করে পালাতে পারবে না। তাকে ধরা পড়তেই হবে। আইনের আওতায় আসতে হবে।

তিনি জানান, তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এভাবে কেন্দ্রীয়ভাবে সড়ক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করায় অপরাধপ্রবণতা অনেক কমে আসবে। মানুষ স্বস্তিতে সড়ক ব্যবহার করতে পারবেন। পর্যায়ক্রমে গোটা সড়ক নেটওয়ার্কে এ ধরনের ক্যামেরা স্থাপন করা হবে বলেও জানান তিনি। হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি আসাদুজ্জামান মিয়া জানান, কোথাও যানজট সৃষ্টি হলে এখন অফিসে বসেই তা মনিটরিং করা যাবে। কর্তব্য পালনে কেউ অবহেলা করছে কিনা তাও নজরদারিতে আসবে।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান জানান, ঢাকা জেলার উত্তরাঞ্চলের ৪টি প্রবেশ দ্বারসহ গুরুত্বপূর্ণ ১৬টি পয়েন্টে ইন্টারনেট প্রটোকল ক্যামেরা (আইপি) বসানো আছে। পর্যায়ক্রমে এ ধরনের ক্যামেরার সংখ্যা ভবিষ্যতে আর বাড়বে। ঢাকা জেলার পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুল আজিম জানান, ঈদ ও পুজোয় ঘরমুখো মানুষের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে আইপি ক্যামেরা স্থাপন করা হলেও বছরজুড়েই তা চলবে। পুলিশপ্রধানের মতে, সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এই উদ্যোগ সড়ক-মহাসড়কের পরিস্থিতি আরও উন্নত করবে। মহাসড়কে নজরদারির পাশাপাশি কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যের কার্যক্রম জবাবদিহিতার আওতায় আনবে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠ’কে বলেন, মহাসড়কে আইপি ক্যামেরা স্থাপন যাত্রী নিরাপত্তায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে আইপি ক্যামেরা স্থাপনেরও দাবি জানান তিনি। প্রয়োজনীয় মনিটরিং ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হলে মহাসড়কে মানুষের ভোগান্তি অনেক কমে আসবে।

বাংলাদেশ বাস-ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান জনকণ্ঠ’কে বলেন, মহাসড়কে চাঁদাবাজিসহ অপকর্ম রোধে পুলিশের এই কার্যক্রম ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তিনি বলেন, আমরা এর সুফল দেখার অপেক্ষায় আছি। সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে মানুষ সুফল পাবে। লোক দেখানো হলে কিছুই হবে না। কিছুদিন পর দেখা যাবে পুরো বিষয়টিই আলোচনার বাইরে চলে যাবে। তিনি বলেন, পুলিশের এই কার্যক্রম সফল করতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের পক্ষ থেকে সকল প্রকার সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে জাতীয় সড়ক রয়েছে তিন হাজার ৬১৮ কিলোমিটার। আঞ্চলিক সড়ক চার হাজার ৩২০কিলোমিটার ও জেলা সড়ক আছে ১৩ হাজার ৬৫০ কিলোমিটার। ব্রিজের সংখ্যা তিন হাজার ২৩৪টি। কালভার্ট আছে ১৩ হাজার ৭৫১টি। সারাদেশে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত পরিবহনের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। ঈদকে সামনে রেখে প্রায় মহাসড়কেই যানজট লেগেই থাকে। ফেরিঘাটগুলোতে চাঁদাবাজি। রাস্তায় তো আছেই। মহাসড়কজুড়েই চলে পরিবহন নৈরাজ্য। অপরাধীদের দৌরাত্ম্য তো আছেই সমানতালে।

পরিবহন নেতৃবৃন্দ বলছেন, দেশের প্রায় ফেরিঘাটই বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি হচ্ছে। কোন ফেরিঘাটেই সরকার নির্ধারিত টোল দিয়ে গাড়ি পারাপার সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়াও পাটুরিয়া, কাওড়াকান্দি, মাওয়া, শরীয়তপুর, চাঁদপুরসহ সব ঘাটের চিত্র প্রায় একই রকম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বহিরাগত লোকজন এখন ঘাটের মূল নিয়ন্ত্রক। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে ফেরি পারাপার। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঈদ ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত এক বৈঠকে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের কাছে চাঁদাবাজির বিশদ বিবরণ তুলে দেয়া হয়েছে পরিবহন নেতাদের পক্ষ থেকে। এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সেতু মন্ত্রণালয়ের লিখিত আবেদন করা হয়েছে। তারা বলছেন, বেশি চাঁদাবাজির শিকার পণ্যবাহী পরিবহন। এমন বাস্তবতায় মহাসড়কে ও ফেরিঘাটগুলোতে ক্যামেরা স্থাপনের বিকল্প নেই বলে মনে করেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।