চট্টগ্রাম ইপিজেডের তাঁবু বিশ্ববাজার মাতাচ্ছে

ইউরোপ ও আমেরিকায় ভ্রমণপিপাসু আর অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় মানুষের নিত্য অনুষঙ্গ তাঁবু। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধবিগ্রহ ও অন্যান্য কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্যও এটি অতি প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। বাংলাদেশে ততটা তাঁবুর ব্যবহার নেই। তবে এ দেশেই তৈরি তাঁবু বিশ্ববাজার মাতাচ্ছে।

চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (সিইপিজেড) স্থাপিত দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান এইচকেডি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ‘তাঁবু’ সেক্টরে বিশ্বের ২০০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছে। বিশ্ব তাঁবু বাজারের ৩০ শতাংশ এককভাবে এ প্রতিষ্ঠানের দখলে। ২৪ বছর ধরে সিইপিজেডে উৎপাদিত তাঁবু দিয়েই বিশ্ববাজার দখল করেছে শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানটি।

এইচকেডি সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরে ১২৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে শুধু তাঁবু সরঞ্জাম রপ্তানির পরিমাণই ১০৫ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশের বিভিন্ন ইপিজেডে অবস্থিত আটটি তাঁবু কারখানা থেকে মোট ১১৪ মিলিয়ন ডলারের তাঁবু সরঞ্জাম রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে এইচকেডি থেকেই এককভাবে রপ্তানি হয়েছে ১০৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অথচ মাত্র তিন বছর আগেও এইচকেডির রপ্তানি ছিল ৭৫ মিলিয়ন ডলারের। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়, এইচকেডি ইন্টারন্যাশনাল একমাত্র আইএসও-৯০০১:২০০০ সার্টিফায়েড তাঁবু সরঞ্জাম উৎপাদক।

জানা যায়, ১৯৯০ সালে মাত্র ৫০০ শ্রমিক নিয়ে সিইপিজেডে যাত্রা শুরু হয় এইচকেডি ইন্টারন্যাশনালের। শুরুতে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হে বং পার্ককে নিরুৎসাহিতই করেছিলেন তাঁর বন্ধুরা। বাংলাদেশে এই বিশেষায়িত পণ্য উৎপাদনের জন্য দক্ষ শ্রমিক পাওয়া যাবে না বলে তাঁদের আশঙ্কা ছিল। চ্যালেঞ্জ নিয়ে ব্যবসা শুরুর পর প্রথম বছরে মাত্র ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়।

বাংলাদেশে ব্যবসায়িক এই সাফল্য পেয়ে এইচকেডি কর্তৃপক্ষ চীন থেকে প্রতিষ্ঠানের কারখানা এ দেশে স্থানান্তর শুরু করে। সর্বশেষ ২০১১ সালে ‘এইচকেডি আউটডোর ইনোভেশন লিমিটেড’ কারখানাটি কর্ণফুলী ইপিজেডে সরিয়ে আনা হয়। বর্তমানে এইচকেডির প্রধান অফিস হংকংয়ে হলেও সিইপিজেডে অবস্থিত বাংলাদেশ অফিসটি করপোরেট অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে সস্তা ও দক্ষ শ্রমিকের কারণে প্রতিষ্ঠানটির সব কারখানা এখানে স্থানান্তর করা হয়েছে বলে এইচকেডি সূত্র জানায়।

বর্তমানে সিইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেডে ২৬টি প্লটে মোট পাঁচটি কারখানায় প্রায় আট হাজার ৩০০ শ্রমিক কাজ করছেন। এর মধ্যে মাত্র ২৯ জন বাদে বাকি সবাই বাংলাদেশি। কারখানাগুলোর মধ্যে সিইপিজেডে তিনটি এবং কেইপিজেডে দুটি। কর্মরতদের ৮৫ শতাংশই নারী। এ খাতে এইচকেডির বিনিয়োগ ১০০ মিলিয়ন ডলার।

এইচকেডিতে বিভিন্ন আকারের তাঁবু তৈরি করা হয়। একজন থেকে সর্বোচ্চ ১২ জন থাকার মতো বৃহৎ তাঁবুও তৈরি হচ্ছে এখানে। এ ছাড়া ক্যারি ব্যাগ, ব্যাক প্যাক, কট, পোর্টেবল চেয়ারসহ সম্পূর্ণ তাঁবু প্যাকেজই তৈরি করছে এইচকেডি।

জানা গেছে, প্রতিবছর এইচকেডি থেকে প্রায় ছয় লাখ তাঁবু বিদেশে রপ্তানি করা হয়। গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, স্পেন, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, পানামা, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন। এ তাঁবুর প্রধান ক্রেতা বিশ্বখ্যাত চেইনশপ ওয়ালমার্ট ও কোলম্যান। এ ছাড়া কে মার্ট, একাডেমি ও বাফেলোর মতো নামিদামি সুপারশপও এইচকেডি থেকে তাঁবুসামগ্রী ক্রয় করে।

প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ ইউসুফ মাহবুব আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বে তাঁবুশিল্পের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখন এইচকেডির দখলে। দিন দিন রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানের মালিক কর্তৃপক্ষও বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা, পরিশ্রম ও বিশ্বস্ততাকে মূল্যায়ন করে। এ কারণেই এইচকেডি তাদের যাবতীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলছে।’

দেশে শিল্প-কারখানায় এমনিতে দক্ষ শ্রমিকের সংকট রয়েছে। তাঁবুশিল্পের মতো বিশেষায়িত কারখানায় এ সংকট আরো বেশি। তবে এ সংকট কাটাতে এইচকেডি নিজেরাই বিদেশি বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। আর এ প্রশিক্ষিত শ্রমিকদের কার্যক্রমে খুশি বিদেশি মালিকপক্ষও। দক্ষ শ্রমিকদের ধরে রাখতে তাই শ্রমিক উন্নয়নে এখানে রয়েছে একাধিক কর্মসূচি। সহকারী মহাব্যবস্থাপক (হিসাব ও অর্থ) সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, কম্পানি দুপুরের খাবার, বিনা খরচে পরিবহন সুবিধা, দলীয় বীমা, ভবিষ্যৎ তহবিল, বার্ষিক ১০ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট এবং মাতৃত্বকালীন ছুটি সুবিধা নিশ্চিত করেছে।

কাজের ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানের সাধারণ স্টাফ ও শ্রমিকদের দক্ষতাকে মূল্যায়ন করা হয়। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রোমানা পারভীন। তিনি ১৯৯৪ সালে সাধারণ একজন অপারেটর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন এইচকেডিতে। আর আগামী ১ অক্টোবর থেকে পদোন্নতি পেয়ে রোমানা সহকারী মহাব্যবস্থাপক (উৎপাদন) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করবেন। এ প্রসঙ্গে রোমানা বলেন, ‘অপারেটর হিসেবে আমি ৮০০ টাকা বেতন পেতাম। আর এজিএম হিসেবে আমার বেতন হবে ৭০ হাজার টাকা। অথচ আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা দশম শ্রেণী। বাস্তবে প্রতিষ্ঠান আমার পড়ালেখা নয়, কর্মদক্ষতাকেই মূল্যায়ন করেছে।’