শীঘ্র ১৫ প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগ আসছে ॥ ৪৭ হাজার কোটি টাকা

০ কাল চীনের এক্সিম ব্যাংক প্রতিনিধি দলের ইআরডির সঙ্গে বৈঠক ০ গঙ্গা ব্যারাজ ও যমুনা নদীতে রেল সেতু নির্মাণের অর্থ সংস্থান হচ্ছে

শীঘ্রই বাংলাদেশে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে চীন। ১৫ প্রকল্পে এ অর্থ ব্যয় করা হবে। চীন-বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ফলে সহযোগিতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে এটি করছে। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে ঢাকায় আসছে চায়না এক্সিম ব্যাংকের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল। মঙ্গলবার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠক করবে প্রতিনিধিদলটি। বৈঠকে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে ইআরডি সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিনের। অনুষ্ঠেয় বৈঠকে প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর ঋণের সুদের হার এবং কোন্ প্রকল্পে কত অর্থ বিনিয়োগ করবে সে বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে চীনবিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আসিফ-উজ-জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জনকণ্ঠকে তিনি প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও কী নিয়ে আলোচনা হবে বা প্রতিনিধিদলে কে কে থাকছেন সেসব বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারব না।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত ১৫ প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প, এটি বাস্তবায়নে চীনের বিনিয়োগ ধরা হয়েছে প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্প, এটি বাস্তবায়নে চীনের বিনিয়োগ হবে ৮০ কোটি মার্কিন ডলার। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ইনফো সরকার-২ প্রকল্প, এটি বাস্তবায়নে চীনের বিনিয়োগ ধরা হয়েছে ২০ কোটি মার্কিন ডলার। এছাড়া রয়েছে বিদ্যুত খাতের আওতায় প্রি-মিটারিং প্রকল্প, আধুনিক ট্রান্সফরমার ক্রয় প্রকল্প, এস্টাবলিশমেন্ট অব ফোর টিয়ার ন্যাশনাল ডাটা সেন্টার প্রকল্প, চট্টগ্রাম রিফিউনারি স্থাপন প্রকল্প।
সূত্র জানায়, দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক পরিবর্তনজনিত বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা করে সরকার। সাত বছরের বেশি সময় ধরে চলছে সমীক্ষা-কর্মশালা, সভা ও সেমিনার। ফলে দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও আলোর মুখ দেখেনি প্রায় ৩১ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ প্রকল্পটি। তবে এবার সেটি আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। এ প্রকল্পে প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে চায়না এক্সিম ব্যাংক।

ভারত ৪০ হাজার কিউসিক পানি প্রত্যাহার করায় সরকারের পক্ষ থেকে গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ জন্য ২০০৫ সালে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করতেই পার হয়ে গেছে সাত বছরের বেশি সময়। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় গঙ্গানির্ভর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩৭ শতাংশ এলাকার কৃষি, মৎস্য উৎপাদন, গঙ্গা অববাহিকার নদীগুলোতে নৌ-চলাচল চরমভাবে কমে গেছে। একই সঙ্গে লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ছে এসব অঞ্চলে।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে গঙ্গানির্ভর নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। শুষ্ক মৌসুমে চাহিদা অনুযায়ী এলাকার নদীগুলোর মধ্যে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। ওই এলাকার বিশাল অঞ্চলে সেচের ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে। এছাড়া মূল ব্যারাজ ও গড়াই অফটেক স্ট্রাকচারে ১১৩ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এছাড়া সেচ সমস্যা সমাধান হওয়ায় এ এলাকায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন ধান বেশি উৎপাদন হবে। অতিরিক্ত মাছ উৎপাদন হবে বাৎসরিক আড়াই লাখ মেট্রিকটন।

পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প নিয়ে সমীক্ষার কাজ সম্প্রতি শেষ হয়েছে। এর আগেও বিভিন্ন ধরনের স্টাডি হয়েছে। অর্থ সংস্থানের অভাবে গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প আর এগোয়নি। এ প্রকল্পে ২ হাজার ১০০ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট মূল ব্যারাজ, ৭৮ স্পিলওয়ে, একটি নেভিগেশন লক, দুটি ফিশপাস ও অন্যান্য স্থাপনাদি তৈরি করার কথা রয়েছে। অপরদিকে এ প্রকল্পের আওতায় গড়াই অফটেক স্ট্রাকচার তৈরি করা হবে। যার দৈর্ঘ্য হবে ৩৯০ মিটার। এখানেও ১৫ স্পেলওয়ে, একটি নেভিগেশন লক ও একটি হাইড্রোপাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, এ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল ব্যারাজ ১৩ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা, গড়াই সিস্টেম ৫ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা, হিসনা সিস্টেম ৩ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা, চন্দনা সিস্টেম ৫১৩ কোটি টাকা, রেলওয়ে ব্রিজ ১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা, গ্রোয়েন ও রিভার ট্রেনিং ওয়ার্কস ৩ হাজার ৩২০ কোটি টাকা, বন্যা বাঁধ ও লিংক রোড ৯৩৭ কোটি টাকা ও অন্যান্য খরচ ২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যা ব্যয় হবে তা প্রকল্প নির্মাণ শেষের পাঁচ বছরের মধ্যে প্রকল্পের ব্যয় উঠে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, প্রায় ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে গঙ্গা নদী বাংলাদেশে পড়েছে ২৪০ কিলোমিটার। দেশের ৪৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা এ নদীনির্ভর অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ১৯৭৫ সালে গঙ্গার উজানে ফারাক্কা নামক স্থানে একটি ব্যারাজ প্রকল্প চালু করে ভারত। ফলে গঙ্গা নদীতে পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তর সাতটি জেলার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিপর্যস্ত অবস্থায় পতিত হয়। একই সঙ্গে, এ অঞ্চলের ৩৭ শতাংশ এলাকার কৃষি, মৎস্য চাষ ও নৌ চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি হয়েছে।

সূত্র জানায়, চীনের অর্থে প্রায় ৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে যমুনা নদীর ওপর বিদ্যমান সেতুর সমান্তরাল ডাবল ট্রাক বিশিষ্ট ডুয়েলগেজ একটি রেল সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। এতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৯ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। চলতি বছরের নবেম্বরে বিশদ ডিজাইন ও নির্মাণ কাজের তদারকির জন্য পরামর্শক নিয়োগের লক্ষ্যে দরপত্র আহ্বান করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ২০১৬ সালের আগস্টের মধ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ডিজাইন দাখিল, দরপত্র দলিল ও ডিপিপি প্রণয়ন করার কথা রয়েছে। এর পর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। ২০১৭ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ শুরু হবে। তিন বছর মেয়াদী প্রকল্প ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।