‘গ্রোথ বেল্ট বাংলাদেশের’ গুরুত্ব জাপানের কাছে অপরিসীম

হোটেল সোনারগাঁওয়ে জাপান-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরামের আলোচনা সভা

সূর্যোদয়ের দেশ জাপান দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে এই বিনিয়োগ প্রয়োজন। জাপানী প্রধানমন্ত্রী শিনজো এ্যাবেও বললেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করবে জাপান সরকার। বিনিয়োগ আকর্ষণে যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ, সেই উদ্যোগকে জাপান স্বাগত জানায়। এছাড়া বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (বিগ-বি) হিসেবে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে জাপানের কাছে। তবে বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ আরও উন্নত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সফররত জাপান প্রধানমন্ত্রী। একই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকার ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা বললেন, জাপানী বিনিয়োগ আকর্ষণে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। কারণ এই দেশটির সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। সেই সময় জাপান বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছে। তাঁরা বলেন, জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জাপান বাংলাদেশের উন্নয়নে এগিয়ে আসে।

শনিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত বাংলাদেশ-জাপান বিজনেস ফোরাম অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাপান প্রধানমন্ত্রী শিনজো এ্যাবে।

জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের সহআয়োজক বিনিয়োগ বোর্ড ও ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।

অনুষ্ঠানে শিনজো এ্যাবে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধিতে বিদ্যুত ও জ্বালানি, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলাসহ সাবির্ক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন। আর এসব অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশের পাশে আছে জাপান সরকার ও সেই দেশের উদ্যোক্তা বিনিয়োগকারীরা। তবে এদেশে বিনিয়োগ করতে জাপানী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করবে জাপান সরকার।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মে মাসে জাপান সফর করেন। বিষয়টি উল্লেখ করে শিনজো বলেন, ওই সময় তাঁকে পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে ৬০০ কোটি সহায়তার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। ইতোমধ্যে ১২০ কোটি ডলারের চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশকে আরও উন্নত করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তিনি তাঁর দেশের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের এ ব্যাপারেও উৎসাহিত এবং বিনিয়োগ করার তাগিদ দিবেন।

এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান। এ ছাড়া বিজনেস অধিবেশনে বাংলাদেশের দুইজন ও জাপানের আটজন ব্যবসায়ী পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনের মাধ্যমে উভয় দেশের পণ্য ও বিনিয়োগ সম্ভাবনার চিত্র তুলে ধরেন। তবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন্ত্রীরা অংশগ্রহণ না করে দ্বিতীয় পর্বে তাদের বক্তব্য রাখেন। এর আগে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ ইয়ার্ডের এমডি সাখাওয়াত হোসেন বক্তব্য রাখেন। সমাপনী বক্তব্য দেন বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান একে সামাদ।

অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, জাপানী সহায়তায় দেশের কয়েকটি বড় ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে বিএসটিআইয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কার্যক্রম, বাংলাদেশ স্টিল ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন অন্যতম। এছাড়া প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ জাপানী কোম্পানি মিৎতস্যুবিসির সহায়তায় পাজেরো জীপসহ সিডেন কার তৈরি করছে। এছাড়া বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জাপানের অবদান অনেক। তিনি বলেন, দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধিতে জাপানী বিনিয়োগ প্রয়োজন।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ঐতিহাসিকভাবেই জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মধুর। এ কারণে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। তিনি বলেন, জাপানী বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে। বিশেষ করে তাদের বিশেষ অর্থনৈতিক জোন করার জন্য যা যা করা দরকার সরকার তাই করবে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহারিয়ার আলম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের সময় বেশ কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় এবারের সফর। তিনি বলেন, বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ এখন আকর্ষণীয়। এ কারণে বন্ধুপ্রতীম দেশ জাপানের বিনিয়োগকারীরা এদেশে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন। দেশের জিডিপি, রেমিটেন্স, ইপিজেড সুবিধা, ইইউতে রফতানিতে শুল্ক সুবিধাসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যুত ও জ্বালানি, গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি স্টোরেজ টার্মিনাল, ট্যুরিজম, স্বাস্থ্য, ওষুধ, এসমএই লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, এলইডি ল্যাম্প তৈরি ও সোলার বিদ্যুত উৎপাদনে তাদের বিনিয়োগ বাড়াতে পারে।

এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দীন আহমেদ বলেন, জাপান সরকার ও ওই দেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের এই ইতিবাচব মনোভাব বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনাকে আরও বেগমান করবে। তিনি বলেন, জাপানী উদ্যোক্তারা এদেশে বড় ধরনের বিনিয়োগ বাড়াতে পারেন। তাঁরা তাদের দেশের ইন্ডাস্ট্রিগুলো বাংলাদেশে রি-লোকেট করতে পারেন। এ ব্যাপারে আমরাও তাদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন। বিশেষ করে বিদ্যুত ও জ্বালানির উন্নয়ন করতে হবে। এ খাতে জাপানী বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত। এছাড়া দেশের টেক্সটাইল, লেদার ও ওষুধসহ অন্যান্য খাতে এখন জাপানের বিনিয়োগ দরকার।

ওই অনুষ্ঠানে জাপানী উদ্যোক্তা শিপ হেলথ কেয়ারের সিইও কুনিহিসা ফারুকা, মারুশিয়া কোম্পানির প্রেসিডেন্ট কিমিনবো হিরাইসি, মাইকাওয়া কোম্পানির ইছিজি ইছুজু, ইউগ্লেনার প্রেসিডেন্ট মিটসুরো, বোনামেক্স কোম্পানির সিইও ইউকিও ইয়ামাডা বক্তব্য রাখেন। তাঁরা বলেন, জাপানী অনেক উদ্যোক্তাই বাংলাদেশে বিনিয়োগে আসছে। এ জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন। বিশেষ করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরিসহ ইপিজেডগুলোতে প্লট বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখতে হবে।