কৃষিজমি রক্ষার উদ্যোগ ॥ পল্লী জনপদ হচ্ছে

০ সাত এলাকায় পাইলট স্কিম
০ সমবায়ভিত্তিক বহুতল ভবন নির্মাণ মহাপরিকল্পনা
০ উন্নত বিশ্বের আদলে গুচ্ছগ্রামের আধুনিক সংস্করণ
০ থাকছে বিদ্যুত পানি গ্যাস ঋণসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা
০ এ্যাপ্রোচ সড়কের পাশে গড়ে তোলা হবে চারতলা ভবন

গ্রামের কৃষিজমি রক্ষায় সমবায়ভিত্তিক বহুতল ভবন নির্মাণের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার। এর নাম দেয়া হয়েছে পল্লী জনপদ নির্মাণ। প্রথম পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে দেশের সাতটি স্থানে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। একটি এ্যাপ্রোচ রোডের মাধ্যমে এর দুই ধারে বাড়ি তৈরি করা হবে। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হলে বিক্ষিপ্ত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য স্বল্পব্যয়ে বহুতল হাউজিং প্রকল্প তৈরির পাশাপাশি সৌরবিদ্যুত, বায়োগ্যাস, পানি সরবরাহসহ এর বাসিন্দাদের উন্নয়নে ঋণ, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতিতে গ্রাম গড়ে তোলা হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি একেবারেই নতুন। তাই প্রথমদিকে হয়ত এর সঙ্গে গ্রামীণ সাধারণ মানুষদের সম্পৃক্ত করতে কিছুটা সমস্যা হবে। কিন্তু মানুষ সচেতন হলে কৃষিজমি রক্ষায় আমাদের এ মহৎ উদ্যোগ পল্লী জনপদ তৈরি প্রকল্প সফল হবে। তিনি বলেন, জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধিসহ দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বসতবাড়ি, কলকারখানা, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, নদীভাঙ্গন ও বন্যার কারণে প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি রক্ষা করা সম্ভব হবে। সূত্র জানায়, কৃষিজমির অপচয়রোধ এবং জৈবসারের ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমবায়ভিত্তিক এই বহুতল ভবন পল্লী জনপদ নির্মাণ প্রায়োগিক গবেষণা সংক্রান্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২৪ কোটি ৩৩ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩৬২ কোটি ৯৮ লাখ এবং সুবিধাভোগীদের ৬১ কোটি ৩৫ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও রংপুর বিভাগের একটি করে মোট সাতটি এলাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে নির্বাচিত গ্রামে একটি এ্যাপ্রোচ সড়কের দুই ধারে চারতলা আবাসিক ও অন্যান্য সুবিধা সংবলিত সাতটি ভবন নির্মাণ, বহুতল ভবনে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি পালনসহ উৎপাদিত কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের সুবিধাদি স্থাপন, সৌর প্যানেল স্থাপন, নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা, পানি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে আধার নির্মাণ, অগ্নিনির্বাপণের সুযোগ ও পরিবেশ উন্নয়নে লেক নির্মাণ, রান্নার কাজের জন্য কমিউনিটিভিত্তিক বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট নির্মাণ, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট থেকে উৎকৃষ্টমানের জৈবসার উৎপাদন ও বিপণন, সুফলভোগীদের জন্য বিভিন্ন আয়বর্ধনমূলক প্রশিক্ষণ পরিচালনা ও ঋণ বিতরণ, শিশুদের জন্য খেলার মাঠ ও বয়স্কদের হাঁটার ব্যবস্থা রাখা, ভবনগুলোর জানালা ও দরজায় পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, ভবনগুলোর টয়লেট, বাথ ও বেসিন আলাদা আলদা রাখা ইত্যাদি সুবিধা থাকবে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ও কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সভাপতি ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, এটি একটি কার্যকর ধারণা, বর্তমানে জমিজমা যেভাবে কমছে, তা আতঙ্কের বিষয়। আমাদের গ্রামগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মানুষ তাদের ইচ্ছেমতো বাড়িঘর, পুকুর, খামার তৈরি করছে। ফলে প্রচুর কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। এহেন প্রেক্ষাপটে এহেন গুচ্ছগ্রামের আদল থেকে পল্লী জনপদ তৈরি করা হচ্ছে। অর্থাৎ এক জায়গায় সব নাগরিক সুবিধা দিয়ে ছোট ছোট টাউনশিপ গড়ে তোলা হবে। পরবর্তীতে সহজ ও দীর্ঘমেয়াদী কিস্তিতে বসবাসকারীরা এর মালিকানা পাবেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হওয়ায় এর পাইলট প্রকল্পটি যাতে সফল হয় এবং পরবর্তীতে ব্যাপকভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে যাওয়ার জন্য কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জনবহুল বাংলাদেশে কৃষিজমির পরিমাণ বিভিন্নভাবে প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে। কৃষিনির্ভর এ দেশে জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূমিক্ষয় ইত্যাদি কারণে আবাদী জমির ওপর একদিকে যেমন চাপ পড়ছে, অপরদিকে রাসায়নিক ও ক্ষতিকর পদার্থ ব্যবহারের ফলে জমির উৎপাদনশীলতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কৃষিজমির এ অপচয় রোধ একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কৃষিজমির অপচয় রোধ করে পুনরুদ্ধারের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ প্রকল্পটি হাতে নিচ্ছে সরকার। এ পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হলো বহুতলবিশিষ্ট আবাসিক ভবন নির্মাণের মাধ্যমে উৎপাদনশীল কৃষিজমির অপচয় রোধ করার পাশাপাশি জৈব সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের অধিকাংশ উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য। তবে সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রথম পর্যায়ে সাতটি স্থানে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। এ প্রকল্পের আওতায় গ্রামের ২৭২ পরিবারকে একটি এ্যাপ্রোচ সড়কের মাধ্যমে নাগরিক সুবিধা দেয়া হবে। ফলে মূল সড়কের সঙ্গে বসতবাড়ির সংযোগ সড়ক হিসেবে সাড়ে ১৬ একর কৃষিজমি সাশ্রয় হবে। বর্তমানে গ্রামগুলোতে অপরিকল্পিত বাড়িঘর থাকায় বিদ্যুত সরবরাহের জন্য ওভারহেড লাইন নির্মাণে বড় অংশের সরকারী অর্থের অপচয় হয়। সেখানে একটি এ্যাপ্রোচ সড়কের মাধ্যমে এ সুবিধা দেয়া গেলে ব্যয় কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য উজ্জ্বল বিকাশ দত্তের মতে, এটি একটি নতুন পরিকল্পনা। কৃষিজমি রক্ষায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সুফলভোগীরা নিজেদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সুযোগ পাবেন। ফলে দারিদ্র্য বিমোচন ত্বরান্বিত হবে। তিনি জানান, এর আগে দেশের ৩টি বিভাগের তিনটি স্থানে ৬ তলা ভবন নির্মাণের প্রস্তাব সংবলিত একটি প্রস্তাব গত ৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হয়েছিল। ওই সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন না দিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হয়। সে অনুযায়ী পরামর্শগুলো পূরণ করে প্রকল্প এলাকা তিনটির স্থলে সাতটি করা হয়েছে। এ হিসেবে মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) গত ৩ জুলাই পরিকল্পনা কমিশনের হাতে আসে। প্রকল্পটি প্রক্রিয়াকরণ করে আগামী জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে।