বাংলাদেশের সমুদ্রপ্রদেশ

মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিজয়ের পর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে ‘বাংলাদেশের সমুদ্র প্রদেশ’ নামে প্রথম সমন্বিত মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। এ মানচিত্র প্রকাশ করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস এ্যান্ড ফিশারিজ।
মিয়ানমারের পর সর্বশেষ ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে রায়ের পর এ ইনস্টিটিউটের গবেষকরা দীর্ঘ তথ্য ও উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ শেষে বুধবার এ মানচিত্র প্রকাশ করে তা পানিসম্পদমন্ত্রী ও চবি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছেন। মানচিত্র প্রণয়নে নেতৃত্ব দেন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী। এই মানচিত্রে ১ লাখ ২১ হাজার ১১০ কিলোমিটারের আয়তন দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ১০ মিটার গভীরতায় অভ্যন্তরীণ জলরাশি, নদীর মোহনা ও অগভীর জলরাশির পরিমাণ ২৪ হাজার ৭৭ বর্গ কিলোমিটার। ১০ থেকে ২শ’ মিটার গভীরতার অগভীর সোপান অঞ্চল রয়েছে ৪২ হাজার ৭ বর্গ কিলোমিটার। এ ছাড়া গভীরতর সমুদ্র অঞ্চল ৪৪ হাজার ৩৮৩ বর্গ কিলোমিটার। যার গভীরতা ২শ’ থেকে ২১০০ মিটার। মহিসোপানের জন্য অবশিষ্ট সমুদ্র অঞ্চল যার পরিমাণ ১০ হাজার ৬৪৪ বর্গ কিলোমিটার এবং গভীরতা হচ্ছে ২১০০ থেকে ২৫০০ মিটার পর্যন্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে গভীরত সমুদ্র অঞ্চল যার মোট আয়তনের ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রণীত মানচিত্রে কোন কোন এলাকায় কি কি সম্পদ থাকতে পারে তাও চিহ্নিত করে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। মানচিত্র প্রণয়নে নেতৃত্বদানকারী অধ্যাপক সাইদুর রহমান বৃহস্পতিবার জনকণ্ঠকে জানান, মানচিত্র প্রণয়নে বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্য উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে আমেরিকার সমুদ্র ও সমুদ্র বিষয়ক সংস্থা (নোয়া), আন্তর্জাতিক সমুদ্র মানচিত্র বিষয়ক গ্রুপ গেবকো, বে-অব বেঙ্গল লার্জ মেরিন ইকো সিস্টেম প্রজেক্ট, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রজেক্ট, জাতিসংঘের সমুদ্র আইন বিষয়ক কনভেনশন (আনক্লস), ইটলসের ২০১২ সালের রায়, স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালতের ২০১৪ সালের রায়, ন্যাচারাল আর্থ, বিভিন্ন সমুদ্র বিজ্ঞান ও ভূ-তত্ত্ব বিষয়ক জার্নালের প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ। মানচিত্রের দুটি সংস্করণ করা হয়েছে। এর একটি বাংলা ও অপরটি ইংরেজীতে। 
বুধবার এ মানচিত্র চবি ভিসি অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ ও প্রোভিসি ড. ইফতেষার উদ্দিন চৌধুরীর হাতে অর্পণ করা হয়। এরপর বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে অবস্থানরত পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলামের হাতে দেয়া হয়। এ সময় চবি প্রোভিসি ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মোঃ শাহাদাত হোসেন, প্রফেসর সাইদুর রহমান চৌধুরী, অধ্যাপক ড. এসএম শরীফুজ্জামান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পানিসম্পদমন্ত্রী মানচিত্র গ্রহণ করার পর প্রণয়নকারী সদস্যদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই মানচিত্রটিকে আরও উন্নত ও আপডেট করতে উদ্যোগ নেয়া হবে এবং এতে সংশ্লিষ্ট গবেষকদের সহযোগিতার আহ্বান জানান।
অধ্যাপক সাইদুর রহমান জনকণ্ঠকে আরও জানান, এ মানচিত্র গবেষণার ক্ষেত্রে শিক্ষার ক্ষেত্রে, রেফারেন্স ম্যাপ হিসেবে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা করবে। পাশাপাশি সরকার পক্ষ থেকে সমুদ্রসীমা নিয়ে যখন গেজেট নোটিফিকেশন করা হবে তাতেও কাজে লাগবে। যেহেতু দেশে সমুদ্রসীমা নিয়ে ডাটা ও তথ্যের অপ্রতুলতা রয়েছে সেক্ষেত্রে এ মানচিত্র অবদান রাখবে। তিনি জানান, মানচিত্রে বিভিন্ন স্থানে সমুদ্রের গভীরতা, মৎস্য, খনিজ সম্পদ, তেল-গ্যাস আহরণ এবং ব্লকসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে কোন ব্লকে কি ধরনের সম্পদ রয়েছে তা পেট্রোবাংলা, বাপেক্সসহ সংশ্লিষ্ট মহলগুলো চিহ্নিত করবে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশী সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হওয়ার পর নানা সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে যেহেতু নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে সেক্ষেত্রে তা কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিকে দ্রুত সমৃদ্ধ করতে সরকারী পদক্ষেপ খুবই জরুরী। তিনি আরও জানান, সমুদ্রসীমা নিয়ে দুই প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে সৃষ্ট বিরোধ নিয়ে আদালতের রায়ের পর বাংলাদেশের যে অর্জন তা বিশাল। এতে আমাদের জাহাজ চলাচল ও সামরিক খাতের জন্য বড় ধরনের একটি প্রাপ্তি। উল্লেখ্য, নতুন সমুদ্রসীমা এলাকায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর টহল জাহাজ ও এয়ার পেট্রোল ক্রাফট নিয়মিত পাহারা দিচ্ছে। প্রায় চার দশক ধরে এ এলাকায় ভারত-বাংলাদেশের কোন পক্ষই কোন কাজ করতে পারেনি। ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বাংলাদেশ ১৯ হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি পাওয়ার ক্ষেত্রে যে বিশাল অর্জন তা আগামীতে এর সফলতা কি তা জানতে খুব বেশি দিন সময় নেবে না। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানিগুলো এসব এলাকায় তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদ আহরণে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে সরকার পক্ষে যতদ্রুত কার্যকর সিদ্ধান্ত দিতে পারবে ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অভিমত। প্রসঙ্গত, গত ৭ জুলাই নেদারল্যান্ডের আন্তর্জাতিক আদালতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিয়ে রায় ঘোষিত হওয়ার পর তা ৮ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। এর আগে মিয়ানমারের সঙ্গে অনুরূপ সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতক আদালতে রায় ঘোষিত হয়। ফলে এখন আর সমুদ্রসীমা নিয়ে বাংলাদেশের কোন মাথা ব্যথার কারণ থাকছে না।