ডায়াবেটিস প্রতিরোধে বিধিমালার খসড়া প্রস্তুত

দেশে ৮৪ লাখের বেশি এই রোগে আক্রান্ত
নিখিল মানখিন ॥ এবার ‘জাতীয় ডায়াবেটিস প্রতিরোধ নীতি ২০১৪’ নামে বিধিমালার খসড়া প্রস্তুত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত বিধিমালার খসড়া মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে রাখা হয়েছে। চূড়ান্ত বিধিমালা প্রণয়নের স্বার্থে জনসাধারণের মতামত চাওয়া হয়েছে। জাতীয় ডায়াবেটিস প্রতিরোধ নীতির পাঁচটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, মহামারী আকারে ডায়াবেটিসের বিস্তার লাভ ঘটছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৮৪ লাখের বেশি লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তবে জীবনযাপন পদ্ধতির উন্নয়নের মাধ্যমে এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। এসব কিছুর জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা। মহামারী আকারে বিরাজমান ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার লক্ষ্যে একটি জাতীয় নীতিমালা থাকা আবশ্যক। বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসটির স্বীকৃতি লাভ করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অনুরোধে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর ‘বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস’ পালনের জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব করে,যা পরবর্তীতে গৃহীত হয়। খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, পৃথিবীজুড়েই ডায়াবেটিস বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশে খুব কম বয়সে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার হার আতঙ্কজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ অতিদ্রুত নগরায়ন। দ্রুত নগরায়নের কারণে পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং মানুষের জীবনযাত্রার পদ্ধতিও বদলে যাচ্ছে। শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, চর্বি ও শর্করাসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ, অতিরিক্ত খাওয়া, ক্যালরিযুক্ত ফাস্টফুড ও কোমল পানীয় গ্রহণের অভ্যাস গড়ে ওঠায় মানুষের মধ্যে মোটা হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। আর এ ধরনের লোকদেরই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। ডায়াবেটিস প্রধানত চার প্রকারের। সেগুলো হলো- টাইপ-১, টাইপ-২, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও অন্যান্য বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস। অন্যান্য দেশের তুলনায় ব্যতিক্রমভাবে বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস রোগীর প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগ টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কিন্তু টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া এবং ডায়াবেটিসজনিত দীর্ঘকালীন জটিলতা প্রতিরোধ ও হ্রাসকরা সম্ভব।
খসড়া বিধিমালায় আরও বলা হয়েছে, ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ প্রতিবছর ‘ ১৪ নবেম্বর’ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশের জন্য এটা অত্যন্ত গৌরবের বিষয় যে, আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে এ দিবসটির স্বীকৃতি লাভ করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অনুরোধে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর ‘ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস’ পালনের জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব করে। এর ফলে গত ২০০৭ সাল থেকে জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রে প্রতিবছর ১৪ নবেম্বর জাতিসংঘের একটি দিবস হিসেবে ‘বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘের রেজুলেশন অনুযায়ী জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য একটি জাতীয় নীতিমালা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের বিষয়ে জাতিসংঘের শীর্ষ সম্মেলনে যে ঘোষণা গৃহীত হয়েছে সেখানেও অন্যতম অসংক্রামক রোগ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
]দেশে গত দশ বছরে নতুন ৩৪ লাখ ডায়াবেটিক রোগী শনাক্ত হয়েছে। বর্তমানে দেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮৪ লাখ। অথচ গত ২০০৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫০ লাখ। একইভাবে বিশ্বেও বেড়েছে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা। বর্তমানে বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৭ কোটিতে। অথচ ২০০৩ সালে সারাবিশ্বে ডায়াবেটিক রোগী ছিল ১৯ কোটি। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৫৫ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে রোগী নিজেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সব বয়সের মানুষই আজ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিবছরই দ্বিগণ হারে বাড়ছে নতুন নতুন ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা। সচেতনতার অভাবে অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমানে সারাবিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০ম স্থানে। নানা কর্মসূচী অব্যাহত রাখার পরও দেশের ৮৪ লাখ ডায়াবেটিক রোগীর মাত্র শতকরা ২৫ ভাগ রোগীকে স্বাস্থসেবার আওতায় আনতে পেরেছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে নানা পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর প্রয়োজনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খান। এ ব্যাপারে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের(বাডাস) গৃহীত বহুমুখী কর্মসূচীর বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, বর্তমানে ৫৬টি জেলায় ৫৭টি অধিভুক্ত সমিতি রয়েছে। বাকি ৮টি জেলাতেও অধিভুক্ত জেলাতেও অধিভুক্ত সমিতি গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ডায়াবেটিস সেবার পরিধি বাড়াতে অধিভুক্ত সমিতির পাশাপাশি অধিভুক্ত সমিতির অধীনে উপজেলা পর্যায়ে সহ-অধিভুক্ত সমিতি দেয়ার ব্যাপারেও আমরা বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছি। এক্রিডিটেড ফিজিশিয়ানদের ভূমিকার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষ করে ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ে এক্রিডিটেড ফিজিশিয়ানদের মাধ্যমেও ডায়াবেটিস সেবা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে রোগীকে স্বনির্ভর করতে পারলে রোগীদের চিকিৎসকের প্রতি নির্ভরশীলতা কমে আসবে। রোগী নিজেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সুস্থ জীবনযাপন করতে সক্ষম হবে। কাজেই প্রতিটি হেলথ কেয়ার সেন্টারে হেলথ এডুকেটর থাকা আবশ্যক। হেলথ এডুকেটর ছাড়া যথাযথ ডায়াবেটিস সেবা দেয়া সম্ভব হবে না। এ জন্য ইতোমধ্যে বারডেম, এনএইচএন এবং এইচসিডিপি’র বিভিন্ন কেন্দ্রে হেলথ এডুকেটর নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অধিভুক্ত সমিতিগুলোতেও হেলথ এডুকেটরদের মাধ্যমে ডায়াবেটিক রোগীদের স্বনির্ভর করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশ্ব ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ইতোমধ্যে কয়েক শ’ ডায়াবেটিস এডুকেটরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জীবনযাপন পদ্ধতির দ্রুত পরিবর্তন ও নগরায়নের কারণে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এনার্জিবহুল ফাস্টফুড ও কোমল পানীয় গ্রহণ, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব ইত্যাদি কারণে অনেকের মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। আর এসব কারণে শিশু-কিশোররাও আক্রান্ত হচ্ছে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের মতো বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে। এ অবস্থায় বাডাস সারাদেশে ডায়াবেটিস সেবা সম্প্রসারণের পাশাপাশি ডায়াবেটিস প্রতিরোধেও ব্যাপক কর্মসূচী নিয়েছে।
প্রাথমিক প্রতিরোধ এবং জাতীয় ডায়াবেটিক বিধিমালা সম্পর্কে ডায়াবেটিক সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত, টাইপ-২ ডায়াবেটিস শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি প্রতিরোধযোগ্য। প্রাথমিকভাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের লক্ষ্যে বাডাস কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসাবে সম্প্রতি বাডাস কর্পোরেটভিত্তিক ডায়াবেটিস প্রতিরোধ কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। এই কর্মসূচীর অধীনে বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্বল্পমূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয় ও প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যশিক্ষা দেয়া হবে। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জাতীয় নীতিমালার একটি খসড়া তৈরি করে তা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এতে যেসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে -ফাস্টফুড ও কোমল পানীয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে যাতে প্রতিটি বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নেয়া উচিত। স্কুল-কলেজে খোলা মাঠ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এককভাবে না পারলেও কয়েকটি স্কুল বা কলেজ যাতে সম্মিলিতভাবে একটি খেলার মাঠের ব্যবস্থা করে সে ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে। টিভি-বেতার-সংবাদপত্রে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন বা স্লোগান প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার। এলাকাভিত্তিক ওয়াকিং ক্লাব, সুইমিং ক্লাব গড়ে তোলা উচিত। গৃহায়ন কর্মসূচীর অনুমতি দেয়ার সময় হাঁটাচলার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা ও খেলাধুলার জন্য কিছুটা জায়গা রাখার বিধান রাখা যেতে পারে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে স্বাস্থ্যশিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে(যেমন মসজিদে খুতবার সময়) ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও সুস্বাস্থ্য রক্ষা সংক্রান্ত সচেতনতামূলক বক্তৃতা করার ব্যাপারে ধর্মীয় নেতাদের উৎসাহিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। আর মোবাইল অপারেটররা যাতে প্রতিদিন স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতামূলক সংক্ষিপ্ত বার্তা (এসএমএস) পাঠাতে অন্তত ৩০ সেকেন্ড সময় ব্যয় করে সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন আরও জানান, ডায়াবেটিক রোগীর এমন বৃদ্ধির জন্য দায়ী মূলত জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, বার্ধক্য ও প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ন এবং তার বিভিন্ন প্রভাব, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাব। এ রোগ শিশু-কিশোরদেরও হতে পারে।