প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, বিগত বিএনপির সরকারের কারণে সমুদ্রসীমায় মহীসোপানে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রবিবার সকালে সচিবালয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা জানান। অপরদিকে ২০২১ সালের আগেই দেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার প্রত্যাশা করেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া শুধু ইউনিয়ন তথ্য সেবাকেন্দ্র থেকেই প্রতিমাসে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ সেবা গ্রহণ করছেন। দেশের প্রতিটি জেলায় একটি আইটি ভিলেজ বা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে করার জন্যও তাগিদ দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সমুদ্রে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আমরা ’৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত অনেকখানি এগিয়ে রেখে যাই। আশা ছিল, পরবর্তীতে যারা ক্ষমতায় আসবে, তারা কাজ এগিয়ে নেবে। কিন্তু, দুর্ভাগ্য আমাদের! তারা (বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার) কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
তিনি বলেন, তারা (বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার) সময়মতো পদক্ষেপ নিলে সমুদ্রসীমায় মহীসোপানে যে নির্দিষ্ট জায়গা, আমাদের অধিকার সেটা সুনির্দিষ্ট হয়ে যেত এ রায়ের সঙ্গে সঙ্গে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে কোন কিছুরই একটা সময় থাকে। সে সময়ে তারা সঠিক পদক্ষেপ নেয়নি বলে আমরা পিছিয়ে গেছি। আসলে তাদের এ নিয়ে কোন চিন্তাভাবনাই ছিল না। আমরা আমাদের পুরো অধিকার হারাতাম, যদি ১০ বছরের মধ্যে আবারও দাবিনামা পেশ করতে না পারতাম!
সমুদ্রে অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের সফলতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার কাজটা অত সহজ ছিল না। আমাদের অনেক কাজ করতে হয়েছে। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।
১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সমুদ্রসীমা আইন করে গেছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫-এর পর যারা ক্ষমতায় এসেছিল, ২১ বছর তারা ক্ষমতায় ছিল। দুই-দুইটা মিলিটারি ডিক্টেটর ক্ষমতায় ছিল। তারা কেউ কিন্তু এ বিষয়ে তেমন কোন উদ্যোগ নেয়নি। আমরা ’৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আবার উদ্যোগ নিই। কেবিনেটে বিষয়টি রেটিফাই করি, জাতিসংঘে অনুস্বাক্ষরের ব্যবস্থাও করি।
বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনাদের যাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তা যথাযথভাবে পালন করবেন। মনে রাখবেন, সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর, যার ছয় মাস চলে গেছে। সাত মাস চলছে। আর বাকি আছে চার বছর পাঁচ মাস। এ সময়ের মধ্যে আমাদের সব কাজ শেষ করতে হবে। সবাই সততা, কর্মদক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে দেশকে দ্রুত এগিয়ে নেয়া যাবে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আমরা বলেছি, ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা হবে। কিন্তু তার আগেই আমরা এটা করতে পারব। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হব।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকার সব ধরনের বিশৃঙ্খলা মোকাবেলা করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকার এটা করতে সক্ষম হয়েছে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারার কারণে। মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার এডিপির ৯৬ শতাংশ কাজ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, আগে গ্রামের মানুষ ভাত-কাপড় চাইত। সত্যি কথা বলতে কি, এখন তারা চায় বিদ্যুত। তাঁরা বলেন, আমাদের বিদ্যুত দেন। ইন্টারনেটের গতি কম কেন, এ প্রশ্নেরও জবাব দিতে হয়। মানুষের চাহিদার পরিবর্তন হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, মানুষ আর্থিকভাবে সফলতার মুখ দেখছে। মানুষের সঞ্চয় বাড়ছে। এখন আর সুদের জন্য ঘরের চাল টেনে নিচ্ছে না কেউ।
প্রতিটি জেলায় কেউ যাতে গৃহহীন না থাকে, কেউ থাকলে তাদের খুঁজে বের করে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
৪৮ মিনিটের দীর্ঘ বক্তব্যের বেশিরভাগ সময়ই প্রধানমন্ত্রী তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও এর মাধ্যমে মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দিতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং সফলতার কথা তুলে ধরে বলেন, শুধু ইউনিয়ন তথ্য সেবাকেন্দ্র থেকে প্রতিমাসে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ সেবা গ্রহণ করছেন।
তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নে সরকারের ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন- ঢাকার মহাখালী, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও বরিশালে আইসিটি ভিলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের প্রতিটি জেলায় একটি আইটি ভিলেজ বা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সফটওয়্যার ও আইটি সেবা রফতানি করে ১২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে জানান তিনি। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আউটসোর্সিং করে আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আয় করার ক্ষেত্রে প্রয়োজন ট্রেনিং ও ভাষা শিক্ষা। সরকার এ লক্ষ্যে ব্যবস্থা নিয়েছে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নারীর কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ‘বাড়ি বসে বড় লোক’ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে।
মহাকাশে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ উৎক্ষেপণের প্রক্রিয়া ধীর গতি হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, এ কাজটা ধীর গতিতে হচ্ছে। এটা দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে। আগেই এ কাজ করে ফেলা উচিত ছিল। এসব কাজ একটু সাহস নিয়ে করে ফেলতে হয়। পরিকল্পনা কমিশন থেকে এ বিষয়ে প্রস্তাব বার বার ফেরত পাঠানো প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা আপনাদের পুশ করতে হবে। তিনি বলেন, আপনারা এমনভাবে কমিশনে প্রস্তাব পাঠাবেন যাতে ফেরত পাঠানোর সুযোগ না থাকে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে করার জন্য তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, সব ঠিক থাকলে ২০১৭ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে উৎক্ষেপণ করা সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রক্রিয়া শুরু করে। এর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনালের (এসপিআই) সঙ্গে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করে সরকার।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বক্তব্য রাখেন মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। এ সময় তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ডাক ও টেলিযোগ বিভাগের সচিব আবু বকর সিদ্দিক, তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের সচিব এন আই খানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। মতবিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয়ে খোঁজখবর নেন।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় নামে পুনর্গঠন করায় বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে একীভূত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দুই মন্ত্রণালয় একীভূত করার আগে গত ১২ জানুয়ারি গঠিত মন্ত্রিসভায় দুই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন লতিফ সিদ্দিকী। আর এই মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জুনাইদ আহমেদ পলক। এর আগেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সর্বশেষ গত ১০ জুলাই মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেন শেখ হাসিনা। তার আগে ৬ জুলাই যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, ১৯ জুন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, ২২ মে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, ১৮ মে তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৫ মে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, ৭ মে বেসামরিক বিমান, পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, ১০ মে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং ৩০ এপ্রিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া শ্রম মন্ত্রণালয়, বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও যান শেখ হাসিনা।