বাংলাদেশী সমুদ্রসীমায় এ পর্যন্ত ১৯টি তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কূপ খনন হয়েছে। এতে গ্যাসের ভান্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে দুটিতে। এর মধ্যে শুধু বঙ্গোপসাগরে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপকূলের কাছাকাছি সাঙ্গু ক্ষেত্রটিতে গ্যাস উৎপাদন করা গেছে। এ ক্ষেত্র থেকে নির্বিচারে গ্যাস উত্তোলনের ফলে ইতোমধ্যে এটির অপমৃত্যুও ঘটেছে। অপরদিকে, সাগর বক্ষে আবিষ্কৃত অন্য গ্যাসক্ষেত্র কুতুবদিয়ায় মজুদের পরিমাণ উত্তোলন করতে গেলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে না বিধায় এটিকে উৎপাদনে আনা হয়নি।
ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিজয়ের পর যে ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি এলাকা বাংলাদেশের ভাগে এসেছে তাতে গ্যাসের বিশাল ভান্ডারের অস্তিত্ব রয়েছে বলে ভূবিজ্ঞানীদের নিশ্চিত ধারণা। ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী এ বিজয়ের পর তেল-গ্যাস ব্লক পুনর্বিন্যাস করতে নির্দেশনা প্রদান করেছেন। ফলে চলতি বছরই নতুন করে দরপত্র আহ্বান করবে বলে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানানো হয়েছে। অপরদিকে, খুব সহসা সমুদ্রসীমা নিয়ে নতুন গেজেট প্রকাশ করা হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ নৌবাহিনী নতুন সমুদ্রসীমায় তাদের নৌ ও বিমান টহল শুরু করে দিয়েছে। নৌবাহিনীর তিনটি যুদ্ধজাহাজ এ এলাকায় নিয়মিত টহলদানে নিয়োজিত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমার মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি। এ এলাকাটি এতই বিশাল যে, এটিকে আয়তনের দিক দিয়ে আরেকটি বাংলাদেশ বললেও অত্যুক্তি হবে না। সমুদ্র বিজ্ঞানী ও ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, গভীর সমুদ্রের ১০ নম্বর ব্লকের কিছু অংশ ভারত দাবি করায় ২০০৮ সালে ঐ অংশ বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। যেখানে এখন তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি কনোকোফিলিপস। এই কোম্পানি ইতোমধ্যে তাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর ধারণা দিয়েছে, এখানে রয়েছে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের মজুদ। আন্তর্জাতিক আদালতে রায়ের ফলে ওই ১০ নম্বর ব্লকটির অধিকার সম্পূর্ণভাবে পেয়েছে বাংলাদেশ। এতে গ্যাস প্রাপ্তির অপার সম্ভাবনার হাতছানি রয়েছে। ফলে পেট্রোবাংলা, জ্বালানি মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো আদালতের রায়ের পর ইতোমধ্যে তাদের কার্যক্রম নিয়ে তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য যেমন নতুন দুয়ার খুলে দেবে, তেমনি দেশজুড়ে যে চরম গ্যাস সঙ্কট বিরাজমান তা অনেকাংশে লাঘব হবে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। পেট্রোবাংলা সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে, নতুন ওই এলাকাটিতে গত প্রায় ৪০ বছর ধরে ভারত-বাংলাদেশের কেউ কাজ করতে পারেনি। ভারতের সমুদ্র বিজ্ঞানীরাও এ অংশে তেল-গ্যাস মজুদের সম্ভাবনার কথা বহু আগে ব্যক্ত করেছেন। এতে করেই ভারত আন্তর্জাতিক আদালতে এলাকাটি তাদের অংশ হিসেবে দাবি করে স্বপক্ষে রায় আনার ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েছে। কিন্তু নেদারল্যান্ডসের এ আদালতে ৫ বিচারকের মধ্যে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক বিচারক বাদে বাকি ৪ জনই যে সম্মিলিত রায় দিয়েছেন তাতে পুরো এলাকাটি বাংলাদেশের পক্ষে এসে গেছে। এখন এর সদ্ব্যবহার করা গেলে তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদ আহরণে বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করছে বিশাল সম্ভাবনা। উল্লেখ্য, দীর্ঘ সময় ওই এলাকায় বিদেশী কোন কোম্পানিকে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহী করা যায়নি। এর মূল কারণ ছিল বিরোধপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষিত হওয়ার কারণে। ইতোপূর্বেকার সরকারগুলো এ নিয়ে তেমন তৎপরতা যেমন চালায়নি, তেমনি আন্তর্জাতিক আদালতে সাহস করে মামলা দায়েরের বিষয়টি ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে এ ব্যাপারে নানা চিন্তা-ভাবনা করে আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের সহায়তায় এবং দেশীয় পরামর্শকদের সহযোগিতায় মামলা দায়েরের পর রায় এসেছে দেশের অনুকূলে আর এর ফলে দেশের জন্য বিশাল তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদের অপার হাতছানি দিচ্ছে। এখন অপেক্ষা শুধু এ নিয়ে যথাযোগ্য সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম শুরু করা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশী সমুদ্র বক্ষে একটি মাত্র উৎপাদনশীল গ্যাসক্ষেত্র নিঃশেষ হয়ে যায় গেল বছরের ১ অক্টোবর। মূলত এটির অপমৃত্যু ঘটেছে। নির্বিচারে এক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হয় বিগত বিএনপি সরকার আমলে। গ্যাস সঙ্কট নিরসনে এ ধরনের অস্বাভাবিক গ্যাস উত্তোলনের কারণে গ্যাসক্ষেত্রের ভূগর্ভস্থ স্তর তছনছ হয়ে যায় আর এতে গ্যাস উত্তোলনের পরিমাণ দিন দিন কমতে থাকে। একপর্যায়ে এটি শূন্যের কোঠায় চলে আসার পর তা ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। মাত্র এগারো বছর বয়সেই সাঙ্গুর এই অপমৃত্যু ছিল মনুষ্যসৃষ্ট। এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে ১৯৯৮ হতে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৪৮৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হয়েছে বলে তৎকালীন বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেম লিমিটেড ও বর্তমান কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের পরিসংখ্যানে দেখা যায়। উৎপাদিত এ গ্যাস নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ তেমন লাভবান হয়নি। কারণ, পিএসসি অনুযায়ী উৎপাদিত গ্যাসের প্রায় ৭৪ শতাংশ পেয়েছে বিদেশী কোম্পানি। ভূতাত্ত্বিক প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে তৎকালীন সরকারের নির্দেশে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে গ্যাস উত্তোলন পেট্রোবাংলার তরফ থেকে আপত্তি জানানো হলেও তা মানা হয়নি আর এতেই অপার সম্ভাবনার গ্যাসক্ষেত্র তিলে তিলে তছনছ হয়ে অনুপযোগী হয়ে গেল। এতে দেশের গ্যাস সঙ্কট আরেকধাপ এগিয়ে গেল বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ ক্ষেত্র থেকে গ্যাস সরবরাহ করা হতো। এখন আর সেই সরবরাহ কার্যক্রম নেই। জাতীয় গ্রীড থেকে যে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে তাতে সঙ্কট কাটছে না। ফলে কখনও কাফকো, কখনও সিইউএফএল, কখনও রাউজান তাপবিদ্যুত কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় কেজিডিসিএল (কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড) আর যখন এসব কোম্পানিতে গ্যাস সরবরাহ করা হয় তখন সঙ্কট সৃষ্টি হয় আবাসিকসহ বিভিন্ন গ্যাসসর্বস্ব উৎপাদনশীল বিভিন্ন সংস্থাগুলোতে। সাঙ্গুর অনাকাক্সিক্ষত এই অপমৃত্যু দেশের গ্যাস সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে এনেছে। এ অবস্থায় ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিজয়ের পর যে বিশাল এলাকাটি বাংলাদেশের পক্ষে স্থায়ীভাবে এসে গেছে তাতে অন্যান্য সম্পদের চেয়ে বিশেষ করে গ্যাস সম্পদের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে সম্ভাবনার বিশাল এক দুয়ার।
পেট্রোবাংলার বিভিন্ন দায়িত্বশীল সূত্রে রবিবার জানানো হয়, গভীর ও অগভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানোর জন্য আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের তৎপরতা শুরু হয়েছে। সমুদ্র বিজয়ের পর অর্জিত ১০ নম্বর ব্লকের ইতোপূর্বেকার অংশে মার্কিন অনুসন্ধান কোম্পানি কনোকোফিলিপস কাজ করে যাচ্ছে। এখন যেহেতু আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের ফলে ওই ব্লকের পুরো এলাকাটি বাংলাদেশের পক্ষে এসেছে তার ফলে আন্তর্জাতিক বহু অনুসন্ধান কোম্পানি আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে। ওই সূত্র মতে, গভীর সমুদ্রে এবং অগভীর সমুদ্রের মোট ৭টি ব্লকে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে।
প্রসঙ্গত, ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বাংলাদেশের দাবির প্রেক্ষিতে প্রদত্ত আদালতের রায়ে ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৬৬৭ বর্গকিলোমিটার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব ব্লকে খনিজ সম্পদ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১০টি ব্লকে নিজেদের অংশ রয়েছে বলে ভারত দাবি করে আসছিল। এখন তারা ৬টি ব্লকের কিছু অংশ পেয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ১০ শতাংশ। বাকি ৯০ শতাংশ বাংলাদেশের ভাগে এসেছে। সঙ্গত কারণে পেট্রোবাংলা, সমুদ্রবিজ্ঞানী, ভূ-তত্ত্ববিদসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আশাবাদী- প্রাপ্ত এ বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে তেল-গ্যাসসহ খনিজ সম্পদের বিপুল ভান্ডার। যা বাংলাদেশের ভাগ্যের দুয়ারও খুলে দিতে পারে।