বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যঃ অক্টোবরে উপকূল ঘেঁষে জাহাজ চলাচল শুরু

ভারত থেকে বাংলাদেশ জাহাজে পণ্য আনতে কমপক্ষে ১৫ দিন সময় লাগে। পণ্য আসে শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া অথবা সিঙ্গাপুর হয়ে। সরাসরি ভারতের কোনো বন্দর থেকে চট্টগ্রাম কিংবা মংলা বন্দরে আসে না। এই দীর্ঘপথ ঘুরে আসতে হয় বলে আমদানিকারকদের খরচ হয় প্রতি টনে এক হাজার ২০০ ডলার। আর তাই সমুদ্রপথে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হয় খুব কম।
তবে এই পরিস্থিতি আর বেশি দিন থাকবে না।ভারত থেকে জাহাজে করে সরাসরি বাংলাদেশে আসবে। বাংলাদেশ থেকেও পণ্য যাবে।মূলত সমুদ্র উপকূল ঘেঁষে চলবে এসব জাহাজ।এতে ১৬ ঘণ্টা থেকে আড়াই দিনের মধ্যে বিশাখাপত্তনম, পারাদ্বীপ কিংবা হলদিয়া বন্দর থেকে বাংলাদেশে পণ্য চলে আসবে।এতে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে ব্যয় সীমাবদ্ধ থাকবে ৪০০ ডলারে, যা বর্তমান খরচের তিন ভাগের এক ভাগ।
এই ব্যয় সাশ্রয়ী উপায়টি বাস্তবায়নে গত দুই বছর ধরেই বাংলাদেশ ও ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দুই বছর ধরে একাধিক দফা বৈঠকও হয়েছে দুই দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে। সর্বশেষ গত ২৪ জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের সমুদ্র পরিদপ্তর ও ভারতের নৌপরিবহন পরিদপ্তরের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে আগামী অক্টোবর মাসে দুই দেশের মধ্যে উপকূল ঘেঁষে পরীক্ষামূলক জাহাজ চলাচল শুরু হবে। এতে এক বা একাধিক চালান দুই দেশের মধ্যে আসা-যাওয়া করবে। পরীক্ষামূলক চালানগুলো বিশ্লেষণ করার পর দুই দেশের মধ্যে এ-সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হবে। পরে বাণিজ্যিকভাবে জাহাজ চলাচল করবে।
সভায় সমুদ্র পরিবহন পরিদপ্তরের মহাপরিচালক জাকিউর রহমান ভুঁইয়া ও ভারতের নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গৌতম চ্যাটার্জি নিজ নিজ পক্ষে নেতৃত্ব দেন।
উপকূল ঘেঁষে জাহাজ চলাচল বলতে বোঝায়, এক থেকে দেড় হাজার টন পণ্য পরিবহনযোগ্য জাহাজ উপকূল ঘেঁষে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যায়। এসব জাহাজে কনটেইনার পরিবহন করা হয় না। জাহাজে সরাসরি পণ্য বোঝাই করে আনা হয়। এসব জাহাজকে গভীর সমুদ্রে যেতে হয় না। তাই কম সময়ে পণ্য কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়।
ভারতের তিনটি বন্দর দিয়ে পণ্য আনা-নেওয়া হবে। এই বন্দরগুলো হলো পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া, ওডিষার পারাদ্বীপ ও অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম। আর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরের পাশাপাশি রাজধানীর অদূরে পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল দিয়েও মালামাল পরিবহন করা হবে। মূলত বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সরাসরি জাহাজ যোগাযোগ না থাকায় এখন ভারতের কোনো বন্দর থেকে বাংলাদেশে পণ্য আনতে হলে তা শ্রীলংকার কলম্বো কিংবা মালয়েশিয়ার পেনাং অথবা সিঙ্গাপুরে পণ্য যায় মাদার ভেসেলে (বৃহদায়তন জাহাজ) করে। সেখান থেকে তা লাইটারেজে (ছোট আয়তনের কনটেইনারবাহী জাহাজ) সেই পণ্য তুলে আসতে হয়। একই পথে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য যায়। একটি চালান আসতে সময় লাগে ১৫ থেকে ২১ দিন।
কোস্টাল শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) সূত্রে জানা গেছে, ভারত থেকে বর্তমানে প্রতি টন পণ্য আমদানিতে গড়ে প্রায় এক হাজার ২০০ ডলার ব্যয় হয়। নতুন ব্যবস্থায় সরাসরি জাহাজ চালানো গেলে এ ব্যয় অন্তত এক-তৃতীয়াংশে নেমে ৪০০ ডলার হবে।
সমুদ্র পরিবহন পরিদপ্তর মহাপরিচালক জাকিউর রহমান ভুঁইয়া প্রথম আলোকে জানান, উপকূল ঘেঁষে জাহাজ চলাচল করলে বাংলাদেশের জাহাজমালিকেরাই বেশি লাভবান হবেন। যেহেতু বাংলাদেশ বেশি আমদানি করে, তাই দেশি জাহাজ ব্যবহারে উৎসাহী হবেন আমদানিকারকেরা। এ ছাড়া বাংলাদেশের জাহাজের মান তুলনামূলক ভালো। তবে আন্তর্জাতিক পথে চলাচল করতে মান আরও ভালো করতে হবে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পথে পণ্যবাহী যেভাবে জাহাজ পরিচালনা করা হয়, সেভাবে জাহাজ চলাচলের উপযোগী করতে হবে।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক পথে আট মিলিমিটার পুরুত্বের কাঠামোসম্পন্ন জাহাজ চলাচল করে। আর প্রথম শ্রেণির ক্যাপ্টেন দিয়ে জাহাজ পরিচালনা করতে হয়। পরিবহনকালে পণ্যের মান যাতে সঠিক থাকে, সে জন্য জাহাজের অভ্যন্তরে নানা ধরনের ব্যবস্থা নিতে হয়।
তবে জাহাজে পণ্য পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নেক্সাস করপোরেশনের স্বত্বািধকারী সাইফুল আলম মনে করেন, প্রথম শ্রেণির ক্যাপ্টেন দিয়ে জাহাজ চলাচল করতে হবে, এমন শর্ত যদি ভারত দেয়, তাহলে বাংলাদেশি জাহাজমালিকেরা খুব বেশি লাভবান হবেন না। কেননা, প্রথম শ্রেণির ক্যাপ্টেনদের বেতন-ভাতা অনেক বেশি, যা ব্যবসায়িকভাবে খুব বেশি কার্যকরও হবে না।
প্রসঙ্গত, সমুদ্রগামী জাহাজের ক্যাপ্টেনদের মাসিক বেতন আট থেকে দশ লাখ টাকা। আর উপকূল ঘেঁষে যে ধরনের জাহাজ চলাচল করে, সেসব জাহাজের ক্যাপ্টেনদের বেতন ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। তবে আন্তর্জাতিক পথে চলাচল করলে ক্যাপ্টেনদের বেতন আরও ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
জাহাজমালিকদের হিসাব অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ নদীপথ ছাড়া উপকূলীয় এলাকায় চলাচল করে, এমন জাহাজের (কোস্টাল শিপ) সংখ্যা ১০২টি। উপকূল ঘেঁষে চলাচলের জন্য এসব জাহাজের মধ্যে ৩৭টি বিবেচনায় আনা হয়েছে। এসব জাহাজের কাঠামোর পুরুত্ব আট মিলিমিটার। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ২০ থেকে ২৫টি জাহাজ চলাচল করবে। বাকি জাহাজগুলোর কাঠামো, পরিচালনব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে বলে জানা গেছে।
দুই দেশের মধ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫৭৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। আর ভারতীয় অর্থবছরের (এপ্রিল-মার্চ) হিসাবে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ৬৫০ কোটি ডলার অতিক্রম করে গেছে। এর মধ্যে ভারত থেকে ৬১০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। আর ভারতে রপ্তানি করেছে ৪৬ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য। ২০১০ সালে তামাক ও মাদকজাতীয় ২৫ ধরনের পণ্য ছাড়া সব পণ্যের ওপর বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে ভারত।
তবে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ৯০ শতাংশের বেশি সম্পন্ন হয় স্থলপথ দিয়ে। কিন্তু স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামোগত ঘাটতি, সড়কপথের ঝুঁকি ও সময় বেশি লাগায় বাণিজ্যের ব্যয়ও বেশি হয়।
ভারতের হলদিয়া, বিশাখাপত্তম ও পারাদ্বীপ এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ও পানগঁাও কনটেইনার টার্মিনালের মধ্যে পণ্য পরিবহন হবে
১৬ ঘণ্টা থেকে আড়াই দিনের মধ্যে ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য চলে আসবে
প্রতি টন পণ্য পরিবহনে ব্যয় সীমাবদ্ধ থাকবে ৪০০ ডলারে, যা এখন ১,২০০ ডলার
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয় স্থলপথ দিয়ে।কিন্তু অবকাঠামোগত ঘাটতি, সড়কপথের ঝুঁকি ও সময় বেশি লাগায় বাণিজ্যের ব্যয়ও বেশি হয়

‘‘উপকূল ঘেঁষে জাহাজ চলাচল করলে বাংলাদেশের জাহাজমালিকেরাই বেশি লাভবান হবেন

জাকিউর রহমান ভুঁইয়া

সমুদ্র পরিবহন পরিদপ্তর মহাপরিচালক