যশোরের শার্শা উপজেলার বেনাপোল ইউনিয়নের দক্ষিণ কাগজপুকুর এলাকার কৃষক মো. শহীদুজ্জামান। আট বছর ধরে তিনি ১৬-১৭ বিঘা জমিতে আমন মৌসুমে ভারতীয় উচ্চফলনশীল (উফশী) জাতের ধান ‘স্বর্ণা’ চাষ করছেন। আগে প্রতি বিঘায় গড়ে ২২ মণ ফলন হতো। তবে প্রতিবছর একই ধানবীজ দিয়ে চাষ করায় এখন ফলন কিছুটা কমে বিঘাপ্রতি ১৮ মণে দাঁড়িয়েছে।
একই এলাকার কবির হোসেন বছর পাঁচেক ধরে আট বিঘা জমিতে ভারতীয় জাত ‘স্বর্ণা’ ও ‘মিনিকেট’ চাষ করছেন। স্বর্ণা চাষে সাধারণত প্রতি বিঘায় তাঁর ফলন আসছে ২০ মণ। কারণ তাঁর বীজ শহীদুজ্জামানের চেয়ে কিছুটা কম পুরোনো। অন্যদিকে মিনিকেটের ফলন হচ্ছে বিঘাপ্রতি ২২ থেকে ২৩ মণ।
কবির হোসেন বলেন, ‘গত বছর আমন মৌসুমে দুই বিঘা জমিতে দেশি জাত ‘বাংলামতি’ (ব্রি ধান-৫০) চাষ করেছিলাম। কিন্তু বর্ষার কারণে সেটি ভালো হয় না। তাই ভারতীয় ধানের চাষই করছি।’
শহীদুজ্জামান ও কবিরের মতো বেনাপোলের অধিকাংশ কৃষকই ভারতীয় জাতের ধান চাষ করেন। গত ৩০ জুন বেনাপোলে গিয়ে এমন চিত্রই পাওয়া গেল। উপজেলার কৃষি কর্মকর্তারাও দিলেন একই তথ্য। বেনাপোলে গত আমন মৌসুমে এক হাজার ৭৫০ হেক্টর জমির মধ্যে ৮০ শতাংশতেই ‘স্বর্ণা’ এবং বাকি ২০ শতাংশ জমিতে চাষ হয়েছে দেশি ধানের জাত বিআর-৭ (ব্রি বালাম), ব্রি ধান ৩৯ ও ৪৯। বোরো মৌসুমে এক হাজার ৮২০ হেক্টর জমির মধ্যে ৭৫ শতাংশে মিনিকেট ও বাকি অংশে দেশি ব্রি-২৮ জাতের ধান চাষ হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এসব ভারতীয় জাতের ধানবীজের একটি বিরাট অংশই বেনাপোল স্থলবন্দরের আশপাশ দিয়ে ভারত থেকে আসে, অবৈধ পথে।
অন্যদিকে কৃষকেরাও আগের বছরের সংরক্ষণ করা ধান দিয়ে অর্থাৎ একই বীজ দিয়ে বছরের পর বছর চাষ করছেন। কোনো ক্ষেত্রেই কৃষকেরা ভালো মানের বা প্রত্যায়িত (সার্টিফায়েড) বীজ পাচ্ছেন না। এ কারণে তাঁদের ফলনও বাড়ছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) সাবেক মহাপরিচালক এম এ হামিদ মিয়া বলেন, ‘প্রত্যায়িত বীজে ফলন ১০ শতাংশ বাড়বে। অর্থাৎ বর্তমানের চেয়ে প্রতি বিঘায় দুই মণ ধান বেশি হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বৈধভাবে দুই দেশের সরকার কৃষকদের জন্য এটি সরবরাহ করলে ভালো হয়। আর সাময়িকভাবে এটি না হলে কৃষকদের কীভাবে উন্নত বীজ করতে হবে, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। এতেও অবস্থার অনেকটা উন্নতি হবে।’
একই তথ্য দিয়ে শার্শা উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘উফশী ধানের বীজ তিন থেকে চার বছর প্রায় একই পরিমাণে ফলন দেয়। তার পর থেকে কমতে থাকে। তখন সার্টিফায়েড বীজ দরকার হয়। তবে সেটি না পাওয়ায় কৃষকেরা যে যেভাবে পারছেন সেভাবেই বীজ সংগ্রহ করছেন।’
অবশ্য শুধু বেনাপোল নয়, ভারত সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর ও দিনাজপুরের বিভিন্ন উপজেলায় ভারতীয় ধানের জাত স্বর্ণা, পারিজাত, মিনিকেট ব্যাপক হারে আবাদ হয়। অন্যদিকে ভারতের বিহার, ঝাড়খন্ড ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বাংলাদেশি ধানের জাত বিআর ৮ (আশা), ৯ (সুফলা) ও ১১ (মুক্তা) ও ১২ (ময়না) খুবই জনপ্রিয়। এই জাতগুলো সে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় ১৫-২০ বছর ধরে প্রচুর চাষ হচ্ছে।
বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ‘বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে আনুষ্ঠানিক ধানবীজ বাণিজ্যে বাধা দূরীকরণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের কাজ করছে বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান উন্নয়ন সমন্বয় ও ভারতের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কাটস ইন্টারন্যাশনাল। উভয় প্রতিষ্ঠানই নিজ দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে এসব তথ্য পেয়েছে।
এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া না গেলেও কাটস ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলায় মোট উৎপাদিত ধানের ২০ শতাংশই বাংলাদেশি জাত বিআর-১১ (মুক্তা)। অবশ্য এই জাতটিকে সেখানে বিবি-১১ নামে বাজারজাত করছেন ব্যবসায়ীরা। ভারতের ওই জেলার রানাপুর এলাকার এক চাষিই বছরে ২৫০ থেকে ৩০০ মেট্রিক টন বিআর-১১ ধানের বীজ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করে কৃষকদের কাছে বিক্রি করেন। অবশ্য সেই বীজ মানসম্পন্ন বা প্রত্যায়িত নয়।
কাটস সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন বীজের প্রয়োজন হয়। আর এই বীজের ১২ শতাংশ আসে ভারত থেকে। এর মধ্যে অধিকাংশ অবৈধ পথে। সে হিসেবে প্রতিবছর অবৈধ পথে ১০০ কোটি রুপির সমপরিমাণ মূল্যের বীজ ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে। প্রায় একই পরিমাণ বীজ বাংলাদেশ থেকেও ভারতে যায়। তবে আনুষ্ঠানিক বীজবাণিজ্য শুরু হলে এই পরিমাণটা কিছুটা কম হবে। কারণ প্রত্যায়িত ধানবীজ দিয়ে চাষে যে ফলন আসবে, সেটা দিয়েই আবার পরের বছর চাষ করা যাবে। এভাবে তিন-চার বছর পর্যন্ত চাষ করলে একই ফলন পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে বংলাদেশে তিন কোটি ৪৮ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপন্ন হয়েছে। এর মধ্যে আমন ধান এক কোটি ৩৭ লাখ ৩৮ হাজার মেট্রিক টন, বোরো এক কোটি ৮৭ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন এবং আউশ ২৩ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন।
কাটস ইন্টারন্যাশনালের নীতি বিশ্লেষক সুরেশ প্রসাদ সিং প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে ধানবীজ আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে। তবে কৃষকেরা এ ক্ষেত্রে প্রত্যায়িত বীজ না পাওয়ায় ফলন কম পাচ্ছেন। সে জন্য সরকারি পর্যায়ে বৈধভাবে বীজবাণিজ্যের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এতে কৃষকেরা লাভবান হবেন।’ দুই দেশের মধ্যে কত পরিমাণ বীজ অবৈধভাবে আসে কিংবা যায়, সে বিষয়ে সুরেশ প্রসাদ সিং বলেন, ‘এটি খুবই জটিল। তার পরও কাছাকাছি একটি হিসাব বের করার চেষ্টা করছি আমরা।’
>> বেনাপোল ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর ও দিনাজপুরের বিভিন্ন উপজেলায় ভারতীয় তিনটি ধানের জাত ব্যাপক হারে আবাদ হয়
>> বাংলাদেশ থেকে চারটি জাতের ধানবীজ যায় ভারতের বিহার, ঝাড়খন্ড ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে
>> এসব ধানবীজের একটি বিরাট অংশই অবৈধ পথে সরবরাহ হয়। কিন্তু মান ভালো না হওয়ায় ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ শতাংশ কম হয়
‘‘বৈধভাবে দুই দেশের সরকার কৃষকদের জন্য ধানবীজ সরবরাহ করলে ভালো হয়
এম এ হামিদ মিয়া
সাবেক ডিজি, বাংলাদেশ
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট