প্রতিবেশী দুই দেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মামলায় বিজয়ের পরে ওই অঞ্চলের সমুদ্র সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করবে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগর এলাকার বিশাল সমুদ্র অঞ্চল ঘিরে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই কর্মপরিকল্পনার আওতায় সমুদ্র সম্পদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার রূপরেখাও তৈরি করা হবে। অপরদিকে সমুদ্র সম্পদের সম্ভাবনা খুঁজে বের করতে আগামী ১-২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালারও আয়োজন করা হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মামলা বিজয়ের পরে বঙ্গোপসাগর এলাকার দুই শ’ নটিক্যাল মাইলের বাইরে মহীসোপানে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার সুরক্ষিত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলের আয়তন এখন এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার। ভারত-মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র মামলায় বিজয়ের পরে বাংলাদেশের আওতায় পড়া সমুদ্র অঞ্চলের সম্পদের ক্ষেত্রের অনুসন্ধান ও অর্থনৈতিক মূল্যও নির্ধারণ করা হবে। এছাড়া খুব সহজভাবেই এই সম্পদের সদ্ব্যবহার করা যেতে পারে সেটাও নিশ্চিত করতে চায় সরকার।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ভূভাগের আয়তন এখন এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার। আর বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকার আয়তন এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার। সে অনুযায়ী সমুদ্র অঞ্চলের আয়তন প্রায় আরেকটি বাংলাদেশের সমান। তবে এই সমুদ্র অঞ্চলের সম্ভাবনাকে অতীতের কোন সরকারই কাজে লাগাতে পারেনি। জনবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এখন সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকার এখন সমুদ্র সম্পদ ব্যবহারকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।
বঙ্গোপসাগর দেশের সম্পদের বিশাল উৎস। এই সমুদ্র সীমানার মধ্যে শুধু বিশাল মৎস্য ভাণ্ডার নয়, রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের ভাণ্ডারও। বিশেষ গঠন-প্রকৃতির কারণেই তেল-গ্যাসসহ নানা খনিজ সম্পদ সঞ্চিত রয়েছে এর তলদেশে। এছাড়া সারাবিশ্বে এখন সমুদ্র সম্পদ বিশেষ আকর্ষণের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ তাদের সমুদ্রসীমায় সম্পদের জরিপ, গবেষণা, অনুসন্ধান ও সম্পদ আহরণে ব্যাপক তৎপরতা গ্রহণ করে চলেছে। সে অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশও তার সমুদ্র সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায়।
প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বের অনেক দেশই তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শেষ দিগন্ত হিসেবে টেকসই উন্নয়ন কর্মসূূচীর মাধ্যমে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশের মতো একটি উপকূলীয় দেশের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে সমুদ্র পরিবহন ও বন্দর সহযোগিতা বৃদ্ধি, মৎস্য আহরণ, মৎস্য রফতানি, পর্যটন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ, কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ সর্বোপরি জীববিজ্ঞান ও সমুদ্রবিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নয়নের একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হওয়ার অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। দুই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মামলা জয়ের পরে এসব সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলেছে।
সূত্র জানায়, সমুদ্র অঞ্চলের মৎস্য সম্পদ আহরণ ও তেল-গ্যাস উত্তোলন ছাড়াও নানামুখী উদ্যোগ নিতে চায় সরকার। কেননা বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত তার সমুদ্র এলাকায় মৎস্য সম্পদ আহরণ ও তেল-গ্যাস উত্তোলনকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছে। সমুদ্রসম্পদ ব্যবহারের লক্ষ্যে এই দুটি বিষয়ে বাইরে উল্লেখযোগ্য তেমন কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তবে এখন দুই দেশের সঙ্গে সমুদ্র মামলা বিজয়ের পরে নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে চায় সরকার।
বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই নদীকেন্দ্রিক। সে জন্যই বলা হয়ে থাকে নদীমাতৃক দেশ, বাংলাদেশ। এদেশের মানুষের মধ্যে বরাবরই নদী নিয়েই চিন্তা-ভাবনা সীমাবদ্ধ ছিল। আর সমুদ্র নিয়ে কখনই ভাবেনি বাংলাদেশের মানুষ। সে কারণে অতীতের সরকারগুলোও সমুদ্র নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করেনি। তবে দুই বছরের ব্যবধানে দুটি সমুদ্র মামলা বিজয়ের পরে বাংলাদেশে নতুন করে এখন সমুদ্র সম্পদ নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আর তারই অংশ হিসেবে সরকার এখন সমুদ্র সম্পদ নিয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।
সূত্র জানায়, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের আমলে সর্বপ্রথম দুই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। তখন দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে আলোচনাও হয়। পরে এ বিষয়ে আর কোন অগ্রগতি না হওয়ায় বিরোধ থেকেই যায়। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সে লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয় বাংলাদেশ। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ২০১২ সালের ১৪ মার্চ মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মামলায় জয়লাভ করে। আর ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিরোধ মামলার রায় প্রকাশ করা হয় মঙ্গলবার। মিয়ানমারের পরে ভারতের সঙ্গেও সমুদ্রসীমা মামলায় বিজয়ী হয় বাংলাদেশ।
ঢাকায় আন্তর্জাতিক কর্মশালা ॥ বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায় সরকার। এই লক্ষ্যে একটি কর্মশালা আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী ১-২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হবে। কর্মশালায় বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশের সমুদ্র বিশেষজ্ঞরা যোগ দেবেন। এসব সমুদ্র বিশেষজ্ঞের অভিমত নিয়েই সমুদ্র সম্পদ ব্যবহারের লক্ষ্যে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করবে সরকার। সেই কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ীই সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার করা হবে।