ই-টেন্ডারিংয়ের প্রসার বিশ্বব্যাংকের সন্তোষ

জাহিদুল ইসলাম
টেন্ডারবাজি বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর অন্যতম। টেন্ডার বক্স দখলকে কেন্দ্র করে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, এমনকি খুনাখুনির ঘটনা ঘটছে অহরহ। টেন্ডারকে কেন্দ্র করে নিজ দলের কর্মীদের হাতে জীবন দিতে হয় অনেক রাজনৈতিক কর্মীর। তবে ইলেক্ট্রনিক টেন্ডার ব্যবস্থায় ই-জিপির প্রসারে টেন্ডারবাজি সমস্যা কমে আসছে। এমনই আভাস পাওয়া গেছে সরকারের কেন্দ্রীয় ক্রয় প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট (সিপিটিইউ) ও বিশ্বব্যাংকের তথ্যে। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেড় বছরের কম সময়ে ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে টেন্ডারে অংশ নেয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮ হাজার অতিক্রম করেছে। ২০১২ সালের জুন মাস পর্যন্ত মাত্র ১৪টি ক্রয় আদেশ ই-জিপির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল। আর মে মাসের মধ্যে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৮ হাজারে। প্রাথমিক অবস্থায় মাত্র ২৯৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছিল। বর্তমানে ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে টেন্ডারে অংশ নেয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮ হাজার ৯০০। জানা যায়, ২০১১ সালের ২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ই-গভার্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট ওয়েব পোর্টাল উদ্বোধন করেন। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ পদ্ধতিতে দরপত্রের প্রস্তাব মূল্যায়ন, চুক্তি ব্যবস্থাপনা, অর্থপরিশোধসহ ই-টেন্ডারিংয়ের প্রসারন অনেক কাজ সহজে করা যায়। এতে দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও টেন্ডারবাজি কমেছে, পাশাপাশি বেড়েছে দরপত্রে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা।
সরকারের কেন্দ্রীয় ক্রয় প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট (সিপিটিইউ) সূত্র জানায়, সবচেয়ে বেশি ক্রয় কাজে অংশ নেয়া চারটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ইজিপি কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি), বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ চারটি প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে সরকারের অর্ধেকের বেশি ক্রয় কাজ পরিচালনা করে থাকে। এর বাইরে সেতু কর্তৃপক্ষ, বিবিএস, বিপিসি, বিপিডিপি, বিডব্লিওডিবি, ডিপিএইচই, ডেসকো, ডিপিডিসি, আইএমইডি, ডিসিসি দক্ষিণ, ঢাকা ওয়াসা, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, জিটিসিএল, এলজিইডি, পিজিসিবি, পিডবিস্নউডি, রাজউক, আরএইচডি, আরইবি ও মাউশি এসেছে ই-জিপির আওতায়। তবে সরকারের বড় বড় ক্রয় কার্যক্রম এখনও ই-জিপির আওতায় না আসায় অনেকটাই হতাশ বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাধ্যতামূলক করে দেয়া না হলে বড় টেন্ডার ই-জিপিতে আনতে চাইবে না কেউ। তাছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহারেরও ব্যাপক প্রচলন হয়নি। এ অবস্থায় সব ধরনের টেন্ডার স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আনা সম্ভব নয়।
অবশ্য বড় ক্রয় কার্যক্রমগুলো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আনার প্রত্যাশা রয়েছে সরকারের। এ বিষয়ে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ পাওয়া বাজেটে ১০ শতাংশ অর্থ ই-টেন্ডারিংয়ের আওতায় আনতে হবে। এতে টেন্ডারবাজি অনেক কমে আসবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। জাতীয় সংসদের অনেক সদস্যও এ বিষয়ে একমত হয়েছে বলে তিনি জানান।
সিপিটিইউ মহাপরিচালক অমূল্য কুমার দেবনাথ এ বিষয়ে বলেন, অনলাইনে টেন্ডার ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে দরপত্র ছিনতাই ও দরপত্রদাতাদের ভয়ভীতি দেখানো বা কোনো রকম দুর্নীতি করার সুযোগ থাকছে না। এছাড়া অনলাইনের মাধ্যমে সংস্থাগুলো দরপত্রের বিধিমালা ঠিকমতো মানছে কিনা, তা-ও পর্যবেক্ষণ করা হবে।
সিপিটিইউ দাবি করছে, ইন্টারনেটে টেন্ডার কার্যক্রম পরিচালনা করায় সহজেই অনেক লোক এতে অংশ নিতে পারছেন। এতে টেন্ডার প্রক্রিয়া অনেক সরল ও স্বচ্ছ হয়েছে। টেন্ডারে অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রক্রিয়াটির বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। তবে পল্লী অঞ্চলে ব্যাপক হারে ইন্টারনেটের গতি না থাকায় ই-টেন্ডার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে স্বীকার করছেন সিপিটিইউর কর্মকর্তারা। টেন্ডারে অংশ নেয়া ব্যবসায়ীদের দক্ষতার অভাবটিও তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় নানা ধরনের প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
সিপিটিইউ জানায়, ই-জিপিতে অংশ নিতে ইচ্ছুক সরকারের ২৪টি সংস্থাকে তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ১০ হাজার সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারীকে ১৭ ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, বর্তমানে ৩৯ প্রশিক্ষক ২ হাজার ২০০ কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এর বাইরে আরও ৪০০ কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন ২০ প্রশিক্ষকের কাছে। এর বাইরে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন আরও ৩৫ কর্মকর্তা। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে তৃণমূল পর্যায়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের কমিটি ও নাগরিক সমাজের পরামর্শে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে তৃতীয় পক্ষের নজরদারীও অনেকটা জোরদার হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক জানায়, সম্প্রতি সংস্থাটির উচ্চপদস্থ একটি টিম সরকারি ক্রয় আইন প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ পর্যবেক্ষণ করেছে। এ সময় তারা চ্যালেঞ্জিং কাজটি সম্পন্ন করতে সরকারের প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া সিপিটিইউকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
এর আগে ২০০৪ সালের জুলাই মাসে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাংলাদেশে অনলাইনে টেন্ডারিংয়ের কাজ শুরু হয়েছিল। ২০১১ সালের ২ জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট ওয়েব পোর্টাল উদ্বোধন করেন। এর পর ধীরে ধীরে এ কার্যক্রম চললেও সম্প্রতি এর প্রসার ঘটছে। ২২৭ সাল থেকে চলমান পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রিফর্ম প্রজেক্টের আওতায় ই-জিপি কার্যক্রমে সহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক।