কর্মসংস্থানে মাইল ফলক ॥কোটি নতুন চাকরি

০ ২০১৫ সালের মধ্যে দেশে ও বিদেশে মিলে ১ কোটি লোক কাজ পাবে
০ ২০১৩-১৪ সালে এ পর্যন্ত ৮৯ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ আগামী ২০১৫ সালের মধ্যে এক কোটি নতুন কর্মসংস্থানের মাইলফলক ছুঁতে যাচ্ছে সরকার। দেশ ও বিদেশে মিলে এই পরিমাণ কর্মসংস্থান হবে বলে এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। সংস্থাটির এ হিসাবে চলমান ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার নতুন কর্মসংস্থানের লক্ষ্য অতিক্রম করবে। ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে সদ্য সমাপ্ত ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় ৮৯ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে, এর মধ্যে বিদেশে প্রায় ২৬ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তবে এ হিসাবটি অনুমাননির্ভর বলে মনে করছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, জিইডি এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে অনুমানভিত্তিক। কিন্তু এটি বাস্তবায়ন করতে হলে যে কাজগুলো করা দরকার সেগুলো করা না হলে বাস্তবায়ন হবে না।
এ বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্বে নিয়োজিত সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতি ১ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির ফলে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার দেশীয় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হয়। এ হিসাবের ওপর ভিত্তি করে নতুন কর্মসংস্থানের মোট হিসাব বের করা হয়েছে। তাছাড়া অর্থনৈতিক সূচকগুলো এখন স্থিতিশীল আছে। এ দেশের অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে অগ্রসরমান, যা অতীতের যে কোন প্রবৃদ্ধি প্রবণতা থেকে অনেক বেশি গতিময় এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি অতীতের সমস্ত অর্জনকে ছাড়িয়ে গেছে। তিনি জানান, বর্তমানে প্রতিবছর দেশে ও বিদেশে মিলে গড়ে ২০ দশমিক ০১ লাখ নাগরিকের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের এ পূর্বাভাস সঠিক হলে তা চলমান ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যের চেয়ে বেশি হবে। এক্ষেত্রে পরিকল্পনায় ধরা হয়েছে আগামী ২০১৫ সালের মধ্যে ৯২ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা হবে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে কর্মসংস্থান যা হয়েছে তা প্রায় কাছাকাছি। ফলে আশা করা হচ্ছে পরিকল্পনার মেয়াদ শেষে এ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে নতুন কর্মসংস্থান অনেক বেশি হবে।
এর আগের এক প্রতিবেদনে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ বলেছিল- যদিও জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বেকারত্বের হার কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু তার গতি পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় ধীর। নারীদের ক্ষেত্রে চিত্র ছিল বিপরীত। ২০০৫-০৬ সালের লেবার ফোর্স সার্ভেতে নারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ৭ শতাংশ, যা ২০১০ সালের একই সার্ভেতে নেমে এসে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে। মোট বেকারত্বের হার ২০০৬ সালের তুলনায় সামান্যই কমেছে। এ ছাড়া বলা হয়েছে সামগ্রিক বিবেচনায় দেশের অর্থনীতি যে কোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে সমৃদ্ধ, বিস্তৃত, স্থিতিশীল এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মুক্ত।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ। সে সময় মোট কর্মসংস্থান হয়েছিল এক দশমিক ৯৫ মিলিয়ন। এর মধ্যে দেশে এক দশমিক ৬৬ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান হয়েছিল শূন্য দশমিক ২৯ মিলিয়ন।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। সে সময় মোট কর্মসংস্থান হয়েছিল দুই দশমিক নয় মিলিয়ন। এর মধ্যে দেশীয় এক দশমিক ৪৪ মিলিয়ন এবং বৈদেশিক শূন্য দশমিক ৬৫ মিলিয়ন।
২০০৯-১০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। সে সময় মোট কর্মসংস্থান হয়েছিল এক দশমিক ৯৪ মিলিয়ন। এর মধ্যে দেশীয় এক দশমিক ৫২ এবং বৈদেশিক শূন্য দশমিক ৪২ মিলিয়ন।
২০১০-১১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ। সে সময় মোট কর্মসংস্থান হয়েছিল দুই দশমিক ১২ মিলিয়ন। এর মধ্যে দেশীয় এক দশমিক ৬৮ এবং বৈদেশিক শূন্য দশমিক ৪৪ মিলিয়ন।
২০১১-১২ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ। সে সময় মোট কর্মসংস্থান হয়েছিল দুই দশমিক ২৫ মিলিয়ন। এর মধ্যে দেশীয় এক দশমিক ৫৬ এবং বৈদেশিক শূন্য দশমিক ৬৯ মিলিয়ন।
২০১২-১৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। এ সময় মোট কর্মসংস্থান হয় এক দশমিক ৯৫ মিলিয়ন। এর মধ্যে দেশীয় এক দশমিক ৫১ মিলিয়ন এবং বৈদেশিক শূন্য দশমিক ৪৪ মিলিয়ন। চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ‘শ্রমশক্তি জরিপ ২০১০’-এর (এলএফএস) ফলাফলে বলা হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক খাতে বর্তমানে ৬৮ লাখ লোক কর্মরত রয়েছেন অথচ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে এ খাতে কর্মসংস্থান ছিল এক কোটি দুই লাখ লোকের। এই হিসাবে চার বছরে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান কমেছে ৩৪ লাখ লোকের। শতকরা হিসাবে চার বছরে কর্মসংস্থান কমেছে ৩৩ দশমিক ৩৩ ভাগ। তবে কর্মসংস্থান বেড়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। বিবিএসের হিসাবে সম্প্রতি কৃষিশ্রমিক, দিনমজুর ও পেটেভাতে কাজ করা শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে অবৈতনিক পারিবারিক সহযোগীর সংখ্যা এক কোটি তিন লাখ থেকে ১৫ লাখ বেড়ে বর্তমানে এক কোটি ১৮ লাখে দাঁড়িয়েছে। দুই কোটি ২৮ লাখ থেকে বেড়ে কৃষি, বনজ ও ফিশারি খাতে যুক্ত লোকজনের সংখ্যা ২৯ লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ৫৭ লাখে। আর দিনমজুরের সংখ্যা ৮৬ লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ছয় লাখে। এ সময় দিনমজুর বেড়েছে ২০ লাখ। সব মিলিয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চার কোটি ৭৩ লাখে। অথচ চার বছর আগে এ খাতে নিয়োজিতের সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৭২ লাখ। এ সময় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিক বেড়েছে এক কোটি এক লাখ।
বিবিএসের হিসাবে দিনমজুর ও বিনা বেতনে কাজ করা শ্রমিক হিসাবে ধরে বাংলাদেশে কর্মসংস্থান বেড়েছে। সংস্থার সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী- বর্তমানে বাংলাদেশে মোট বেকারের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ আর বেকারত্বের হার মাত্র সাড়ে চার শতাংশ। চার বছর আগে দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২১ লাখ এবং বেকারত্বের হার ছিল চার দশমিক তিন শতাংশ। এ হিসাবে চার বছরে বেকার লোকের সংখ্যা মাত্র ৫ লাখ বেড়েছে বলে দাবি করেছে বিবিএস।
সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের মধ্যে দেশে দারিদ্র্যের হার বর্তমানে তিন দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে ২০১১ সালের জুন মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় এ অনুমোদন দেয়া হয় এই ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। পরিকল্পনায় ৫ বছরে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়া, ৯২ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, বিদ্যুত উৎপাদন ১৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা, মুদ্রাস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং মোট দেশজ বিনিয়োগ (জিডিপির অংশ) ৩২ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৩ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। মোট বিনিয়োগের ৭৭ শতাংশ ব্যক্তি খাত থেকে, যার পরিমাণ ১০ লাখ ৩৯ হাজার ৩৬০ কোটি। আর সরকারী অর্থায়ন তিন লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এটি মোট বিনিয়োগের ২২ দশমিক ৮০ শতাংশ। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, যা মোট বিনিয়োগের ৯০ দশমিক ৭০ শতাংশ। সুত্র