বহির্বিশ্বে অস্থায়ীভাবে শ্রমিক অভিগমন বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত নতুন বিষয়। স্বাধীনতার কয়েক বছর পর থেকে দেশে শ্রমিক অভিগমন ধীর মাত্রায় শুরু হয়। ১৯৭৬ সালে মাত্র ছয় হাজার শ্রমিক কাজের উদ্দেশ্যে বাইরে গিয়েছিল। ১৯৭৬-৮০ এ পাঁচ বছর সময়পর্বে এক লাখেরও কম প্রবাসী শ্রমিককে বাইরের শ্রমবাজারে কর্মরত দেখা যায়। কিন্তু বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০০৮ সালে অভিবাসী শ্রমিকদের বহির্দেশীয় কর্মসংস্থান ৮ লাখ ৭৫ হাজারে উন্নীত হয়। এরপর ২০১৩ সালে এসে এ কর্মসংস্থান মাত্র ৪ লাখে নেমে যায়।
বহির্বিশ্বে কর্মসংস্থান দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও জনগণের সামগ্রিক কল্যাণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এ অস্থায়ী শ্রমিক অভিগমনের তাত্ক্ষণিক প্রভাব হলো, অভ্যন্তরীণ বেকার কিংবা ছদ্ম বেকার মানুষের একটি স্থিতিশীল ও টেকসই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়া। এই রকম বহির্দেশীয় কর্মসংস্থান কেবল অভিবাসন ব্যয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয়, যা শিল্প-কারখানায় অথবা সেবা খাতে শ্রমিক নিয়োগের প্রাক্কলিত পুঁজি ব্যয়ের তুলনায় কম। এভাবে অভিবাসন অর্থনীতির কর্মসংস্থান ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পেরেছে এবং উদ্বৃত্ত অর্থ অন্য কাজে ব্যবহার করা গেছে।
অনেক বছর ধরে বহির্দেশীয় কর্মসংস্থান জাতীয় অর্থনীতিতে একটি বড় ভূমিকা রেখে আসছে। ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তথ্য থেকে এর গুরুত্বের বিষয়টি ফুটে ওঠে। দেশে ওই সময়পর্বে শ্রমশক্তি ১০.৪ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছে ( বিবিএস, শ্রমশক্তি জরিপ ২০১০)। আর একই সময়ে প্রায় ৪.০ মিলিয়ন শ্রমিক বিভিন্ন দেশে অভিগমন করেছে। অর্থাত্ দেশের বর্ধিত জনশক্তির ৩৮ শতাংশের বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। একই সময়পর্বে দেশে কর্মসংস্থান ৯.৮ মিলিয়ন বৃদ্ধি পায়। অর্থাত্ বর্ধিত কর্মসংস্থানের ৪০ শতাংশেরও অধিক অভিগমনের মাধ্যমে অর্জিত হয়। এই সংখ্যক শ্রমিক যদি বাইরে না যেত, তবে বিদ্যমান কর্মসংস্থানের প্রচণ্ড অভাবের সময়ে অভ্যন্তরীণ শ্রমিকদের জন্য শ্রমবাজার আরো অপ্রীতিকর হয়ে পড়ত। পূর্ণ বেকারত্ব এবং ছদ্ম বেকারত্ব উভয় ধরনের শ্রমিক সংখ্যা বৃদ্ধি পেত এবং মজুরির হার আরো নিম্নগামী হতো।
যেসব শ্রমিক বাইরে কর্মরত তারা দেশে নিজ পরিবারের জন্য আয়ের একটি বড় অংশই পাঠিয়ে দেয়। প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স অতি দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি এখন মোট বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একক বৃহত্ খাতে পরিণত হয়েছে। ২০১৩ সালে প্রবাসী আয় প্রবাহ ১৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যা অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মোট রফতানি আয়ের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি এবং যা মোট দেশজ উত্পাদনের প্রায় ১০ শতাংশ। জাতীয় অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার এই বৃহত্ প্রবাহের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।
প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে তাদের নিজস্ব পরিবারের ব্যয়যোগ্য আয় সমপরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। তাই পরিবারগুলো আগের তুলনায় সচ্ছল হয় এবং ভোগে অধিক অর্থ ব্যয় করতে পারে। বিভিন্ন জরিপ থেকে মনে হয় যে রেমিট্যান্সের সিংহভাগই খাদ্য, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক প্রয়োজনেই ব্যয় হয়। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় দেশে কাজ করে তারা যে পরিমাণ আয় করতে পারত তার তুলনায় রেমিট্যান্স আয় অনেক বেশি। অনুমান করা যায় যে রেমিট্যান্সের ফলে পরিবারগুলোর ভোগের মান ও পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে গেছে এবং তা আয় বণ্টনে কিছুটা সমতা এনেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহের ফলে সৃষ্ট বর্ধিত ভোগ ভোগ্যপণ্য এবং সেবার অতিরিক্ত চাহিদা সৃষ্টি করেছে এবং তা অভ্যন্তরীণ শিল্প-কারখানাগুলোকে এসব পণ্য ও সেবা উত্পাদনে উত্সাহ জুগিয়েছে। রেমিট্যান্সের একটি অংশ ভূমি ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনা কিংবা বাড়িঘর সংস্কারের মতো কাজেও লগ্নি হয়। গ্রামীণ এলাকায় জমির দাম বৃদ্ধির পেছনে রেমিট্যান্সকে অনুঘটক হিসেবে ধরা হয়। রেমিট্যান্সের কারণে ভোগ ও বিনিয়োগ উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা অভ্যন্তরীণ সামগ্রিক ব্যয় বাড়িয়ে জিডিপি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
আন্তর্জাতিক লেনদেন ভারসাম্যে রেমিট্যান্স বড় প্রভাব রেখেছে। এটাকে চলমান লেনদেন মনে করা হয় এবং তাই বর্তমান লেনদেন ভারসাম্যে এটাকে ক্রেডিট আইটেম হিসেবে ধরা হয়। ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে রেমিট্যান্স নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতিকে সর্বদাই ছাড়িয়ে গেছে এবং মাঝে মধ্যে বেশ বড় ব্যবধানে ছাড়িয়েছে। এভাবে রেমিট্যান্স কেবল চলমান ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত সৃষ্টিতে অবদান রাখেনি, উপরন্তু সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যেও উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করেছে। এটা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে বিশাল বৃদ্ধি ঘটিয়ে ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করেছে, যা দেশের ছয় মাসেরও বেশি আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম। এখন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থান বেশ স্থিতিশীল এবং দীর্ঘ সময় ধরে চলমান বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা দেশকে খুব একটা ক্ষতি করতে পারেনি।
লেনদেন ভারসাম্য শক্তিশালী হওয়ার আরেক দিক হলো অভ্যন্তরীণ মুদ্রা শক্তিশালী হওয়া। দেশে বর্তমানে ঠিক এটিই ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বাজারে হস্তক্ষেপ না করত, তাহলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেত। এ রকম বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে আমাদের রফতানি পণ্যের, বিশেষত তৈরি পোশাকের, প্রতিযোগিতার ধার কমিয়ে দিতে পারত। এটা সার্বিক রফতানি আয় কমিয়ে দিতে পারত। এ রকম পরিণাম প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ডলার কিনে টাকার বাহ্যিক মূল্য ধরে রেখেছে। ফলে এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ করেছে।
রিজার্ভের বৃদ্ধি মুদ্রা খাত এবং মুদ্রানীতিতে প্রভাব রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মুদ্রার অংশ। তাই বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের যে কোনো বৃদ্ধি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মুদ্রায় সংযোজিত হয় এবং ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ কয়েকগুণ (৪ গুণেরও অধিক) বাড়িয়ে দেয়। তাই বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের বৃদ্ধি ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহেও অনুরূপ বৃদ্ধি ঘটাবে। পরিণামে এটা অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির হার বাড়াতে পারে। মুদ্রা সরবরাহে কোনো অপ্রত্যাশিত বৃদ্ধি প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি বন্ড ও সিকিউরিটিজ বিক্রির মাধ্যমে রিভার্স রেপো কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। বৈদেশিক মুদ্রা অব্যাহতভাবে ক্রয়ের ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি ২০১২ সালের জুনে ৬৮৯ বিলিয়ন টাকা থেকে বেড়ে ২০১৪ সালের মার্চে ১৩৪৬ বিলিয়ন টাকায় উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি সিকিউরিটিজ বিক্রির মাধ্যমে এর স্থিতি ৩৭৯ বিলিয়ন টাকা থেকে কমিয়ে ৬৩ বিলিয়ন টাকায় নিয়ে এসেছে। ভবিষ্যতে দ্রুতগতিতে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বৃদ্ধি পেলে তা মুদ্রানীতির জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে।
বহির্বিশ্বে কর্মরত প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যার তুলনায় দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। এর প্রধান কারণ, প্রবাসী শ্রমিকদের গড় আয় খুবই কম। এটা আসলে এই বাস্তবতার প্রতিফলন যে অধিকাংশ শ্রমিকই অদক্ষ এবং সেহেতু কম মজুরিতে কর্মরত। গত চার দশকে বাংলাদেশের সরকার বা ব্যক্তিখাত থেকে শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে তেমন কোনো প্রচেষ্টা না নেয়ায় তা শ্রমিকদের কম মজুরি এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তবু বিদেশে জনশক্তি রফতানির পুঞ্জীভূত পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রেমিট্যান্সও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভবিষ্যতে অভিবাসনের ক্ষেত্রে অধিকতর সুযোগ বৃদ্ধির সুযোগ সংকুচিত হতে পারে। যদি দেশ লক্ষণীয়ভাবে শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ না করে, তাহলে রেমিট্যান্সপ্রবাহে বড় ধরনের উল্লম্ফন আশা করা যায় না, এমনকি তা কমে যেতে পারে।
রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাববিস্তারী অংশে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে এটি লেনদেন ভারসাম্যের প্রধান অবলম্বন। সুতরাং বৈদেশিক মুদ্রা আয় অর্জিত হওয়ার অন্যান্য খাত এগিয়ে না আসা পর্যন্ত রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা প্রয়োজন। ২০১২ সালের আগস্ট থেকে বিদেশে শ্রমিক গমনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় চলতি বছরে রেমিট্যান্সও হ্রাস পেয়েছে। অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলার আগেই এ প্রবণতা পাল্টে দিতে হবে। আমাদের পুরনো শ্রমবাজার, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক নেয়া অনেক কমে যাওয়ায় জনশক্তি রফতানিতে ধস নেমেছে। এক্ষেত্রে হারানো শ্রমবাজার ফিরে পেতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর দ্বিগুণ প্রচেষ্টা জরুরি।
লেখক: চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়