জোসনা জমান, দ্য রিপোর্ট : দেশের বৃহৎ তিন নদীর ভাঙ্গনরোধে ‘ফ্ল্যাড অ্যান্ড রিভার ব্যাংক ইরোশন রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইনভেসমেন্ট প্রোগ্রাম’ হাতে নেওয়া হচ্ছে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে অর্থায়ন করবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও নেদারল্যান্ডস সরকার।
কর্মসূচিটি বাস্তবায়িত হবে তিনটি অংশে। প্রথম অংশের কাজ শুরু করতে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে মঙ্গলবার। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এ অনুমোদন দেওয়া হতে পারে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
গৃহীত কর্মসূচির প্রথম অংশে সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলা, টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর এবং মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় (জাফরগঞ্জ), দৌলতপুর ও হরিরামপুর উপজেলায় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম ফেজ বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮২৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১৮৬ কোটি ১৬ লাখ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ ৫২০ কোটি এবং নেদারল্যান্ডস সরকারের অনুদান ১২২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এর বাস্তবায়ন কাজ শেষ করবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো)।
পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য উজ্জ্বল বিকাশ দত্ত এ বিষয়ে জানান, উল্লেখিত তিন নদীর তীর ভাঙ্গারোধে এডিবির অর্থায়নে ইতোমধ্যে একটি সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। যার ভিত্তিতে এ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে এডিবির অর্থায়নে মেইন রিভার ফ্লাড অ্যান্ড ব্যাংক ইরোশন রিস্ক ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় সম্পাদিত সমীক্ষা অনুসারে দেশের তিন প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার ভাঙ্গনপ্রবণ এলাকাগুলোতে তিনটি ট্রান্সে (ফেজে) বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাকে প্রথম ট্রান্সভুক্ত করে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, টেকসই ও স্বল্পব্যয়ে নদী ভাঙ্গনরোধ ও ভাঙ্গন ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি উদ্ভাবন ও প্রয়োগের উদ্দেশ্যে এডিবির আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় যমুনা ও মেঘনা রিভার ইরোশন মিটিগেশন শীর্ষক একটি প্রকল্প ২০০২ সালের জুলাই থেকে ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নকালীন প্রথম ৪ বছরে সাশ্রয়ী ও টেকসই তীর সংরক্ষণ পদ্ধতি চূড়ান্ত করা হয়। এই ধারণায় শুষ্ক মৌসুমে ভাঙ্গন পূর্বাভাস প্রদান, বন্যা মৌসুমে নদীর জরিপ কাজ সম্পাদন, বন্যার পূর্বেই পানির নিচের অংশে নদীর তীর সংরক্ষণ কাজ বাস্তবায়ন, বন্যা পরবর্তী শুষ্ক মৌসুমে অবশিষ্ট সংরক্ষণ কাজ বাস্তবায়ন, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, জরুরি কাজে সহায়তা ও তাৎক্ষণিকভাবে তা বাস্তবায়নের প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে করা হয় বলে এর সাফল্য লক্ষ্যণীয়। এ প্রকল্পের সাফল্যের কারণে পরবর্তী সময়ে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার তীরবর্তী এলাকা ভাঙ্গনরোধে এডিবির অর্থায়নে মেইন রিভার ফ্লাড অ্যান্ড ব্যাংক ইরোশন রিস্ক ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম শীর্ষক একটি সমীক্ষা প্রকল্প সম্পন্ন করা হয়। ওই সমীক্ষার সুপারিশের ভিত্তিতেই এ কর্মসূচির ফেজ-১ গ্রহণ করা হয়েছে।
এর আওতায় প্রধান কার্যক্রমগুলো হচ্ছে- ১৩৬ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ, যমুনার ডান তীরে ২৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, ১৫ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণ কাজ, নতুন চারটি ও মেরামত তিনটিসহ মোট ৭টি রেগুলেটর বা স্ল্যুইসগেট নির্মাণসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. সামসুল আলম দ্য রিপোর্টকে বলেন, এ কর্মসূচি চলমান ষষ্ঠ-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পানি ব্যবস্থাপনা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের নীতি বা কৌশলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে পানি খাতের ১৫৮ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ লক্ষ্যমাত্রার ১৫ কিলোমিটার ও ৬৯০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রার ২৩ কিলোমিটার অর্জিত হবে। তাই কর্মসূচিটি সমসাময়িক ও যুক্তিসঙ্গত।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে ২৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে প্রধান নদীগুলোর হলো- যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা। এই নদীগুলো সবচেয়ে বেশি ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে। দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভাঙ্গনপ্রবণ নদী হলো যমুনা। এ ছাড়া মেঘনা, পদ্মা, তিস্তা, ধরলা, আত্রাই, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, কুশিয়ারা, খোয়াই, সুরমা, মনু, জুরী, সাঙ্গু, ধলাই, গোমতী, মাতামুহুরি, মধুমতি, সন্ধ্যা, বিশখালী ইত্যাদি নদীও যথেষ্ট ভাঙ্গনপ্রবণ। দেশের এসব নদীর প্রায় ১৩০ স্থানে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্যভাবে নদী ভাঙ্গনের ঘটনা ঘটছে। যমুনা নদীর ভাঙ্গনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে সিরাজগঞ্জ জেলা, পদ্মায় কুষ্টিয়া ও শরীয়তপুর জেলা এবং নিম্ন প্রবাহিত মেঘনার শিকার হচ্ছে বরিশাল জেলা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নদীর পাড় গঠনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সবচেয়ে বেশি ভাঙ্গনপ্রবণ হলো যমুনা নদী। সেন্টার ফর ইনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড গ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এর সমীক্ষা প্রতিবেদনের দেখা গেছে, ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যমুনার করাল গ্রাসের শিকার হয়েছে দেশের ৯০ হাজার ৩৬৭ হেক্টর এলাকা। ১৬ হাজার ৪৩৮ হেক্টর এলাকায় ভাঙ্গনের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে।
যমুনার ভাঙ্গনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলা। ইতোমধ্যে যমুনার গর্ভে বিলীন হয়েছে জেলার ২২ হাজার ৭৮৪ হেক্টর এলাকা। যমুনার সবচেয়ে কম ভাঙ্গনপ্রবণ এলাকা হলো পাবনা। এ ছাড়া প্রতিবছর যমুনা নদীর ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জ জেলা। ১৯৭৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যমুনার গর্ভে বিলীন হয়েছে কুড়িগ্রামের ১৮ হাজার ৪৭৯ হেক্টর, গাইবান্ধার ৯ হাজার ৩৪৮ হেক্টর, জামালপুরের ১০ হাজার ৬০৮ হেক্টর, বগুড়ার ১০ হাজার ৯৩৮ হেক্টর, টাঙ্গাইলের ৯ হাজার ১৫০ হেক্টর ও মানিকগঞ্জের ৬ হাজার ৩৩৫ হেক্টর জমি। শুধুমাত্র ২০১২ ও ১৩ সালে এ নদীর ভাঙ্গনের শিকার হয়েছে ৩ হাজার ৭৩৪ হেক্টর এলাকা।