প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গতকাল বেইজিংয়ে গ্রেট হল অব পিপল-এ স্বাগত জানান চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াং।ছবি : পিআইডি
বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহযোগিতা জোরদার করতে বাংলাদেশ ও চীন গতকাল সোমবার দুটি চুক্তি, একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) ও দুটি বিনিময়পত্র (এক্সচেঞ্জ অব লেটারস, সংক্ষেপে ইওএল) সই করেছে। চুক্তি দুটির একটি হলো যৌথ উদ্যোগে পটুয়াখালী জেলায় ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং অন্যটি বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতার বিষয়ে। চট্টগ্রামে চীনা অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগ এলাকা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ও চায়না হারবার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পানির মধ্যে একমাত্র এমওইউটি সই হয়। এ ছাড়া বিনিময়পত্র দুটি হলো উদ্ধার সামগ্রী বিনিময় এবং বাংলাদেশে বন্যা প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সমীক্ষা-সংক্রান্ত।
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব পিপলে গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল এবং চীনা প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াংয়ের নেতৃত্বে তাঁর দেশের প্রতিনিধিদলের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে এমওইউ, চুক্তি ও ইওএলগুলো সই হয়।
জানা গেছে, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ বিষয়ে চুক্তি বা সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশে আলোচনা হলেও তা সই হয়নি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা যায়, চীনাপক্ষ সমঝোতা স্মারকের খসড়ায় পরিবর্তন আনার কারণে বাংলাদেশ এখনই তা সই করতে সম্মত হয়নি। বন্দর রক্ষণাবেক্ষণ ও নকশা প্রণয়নের কাজ চীন তার তত্ত্বাবধানে করতে চায়। এ ছাড়া ঋণের বিষয়ে আলোচনা শুরুর সময় দেওয়ার প্রস্তাব থেকে চীন পরে সরে আসে। এগুলোসহ আরো কয়েকটি কারণে বাংলাদেশ এ বিষয়ে কোনো সমঝোতা স্মারকে সই করার আগে আরো আলোচনার কথা চীনকে জানায়।
অন্যদিকে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশ এ নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী থাকলেও কোনো চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরে প্রস্তুত ছিল না। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জুন বেইজিংয়ের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে ঢাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয়ে সমঝোতায় ইতিবাচক ফল প্রত্যাশা করেছিলেন। দুই মাস আগে তিনিই অন্য এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, গভীর সমুদ্রবন্দর সত্যিই প্রয়োজন কি না, তা বাংলাদেশের আগে ভাবা উচিত।
বার্তা সংস্থা ইউএনবি জানায়, গতকাল বেইজিংয়ে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক ও চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শেষে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের বিষয়টি দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় এসেছিল। উভয় পক্ষ এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছে। তিনি জানান, আলোচনায় বাংলাদেশ পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন সরকারের সহায়তা চেয়েছে। চীনের প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস দেন। এ ছাড়া এগুলো বাস্তবায়নের উপায় ঠিক করতে তিনি তাঁর সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রীকে দায়িত্ব দেন। ওই প্রকল্প পাঁচটি হলো- ন্যাশনাল আইসিটি ইনফ্রা নেটওয়ার্ক ফর বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট ফেজ-থ্রি প্রকল্প, রাজশাহী ওয়াসার পানি পরিশোধনাগার প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহু লেনবিশিষ্ট টানেল নির্মাণ, চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর দ্বিতীয় রেল সড়ক সেতু নির্মাণ এবং চট্টগ্রাম-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুনধুম দ্বৈতগেজ রেললাইন স্থাপন প্রকল্প।
বৈঠকের আগে প্রধানমন্ত্রী গ্রেট হল অব পিপলে পৌঁছালে তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। চীনের প্রধানমন্ত্রী তাঁর দেশের গণ্যমান্য নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শেখ হাসিনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
সহযোগিতার নতুন পথ উন্মোচিত হওয়ার আশা : বাসস জানায়, গতকাল বেইজিংয়ে ‘সাম্প্রতিক বছরে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক সাফল্য এবং চীনের সঙ্গে অংশীদারিত্ব’ শীর্ষক সেমিনারে চীনের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চায়না ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিআইআইএস) বেইজিংয়ে তার নিজস্ব কার্যালয়ে এ সেমিনারের আয়োজন করে। সেখানে শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, চীনে তাঁর বর্তমান সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো জোরদার এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতার এক নতুন পথ উন্মোচিত হবে। তিনি বলেন, ‘আমার চীন সফর একটি বিরাট সাফল্য।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ-ভারত-চীন-মিয়ানমার (বিআইসিএম) অর্থনৈতিক করিডর প্রতিষ্ঠায় চীনের প্রস্তাবের প্রতি বাংলাদেশ সমর্থন জানিয়েছে। একসময়ের জনপ্রিয় ‘সিল্ক রুট’ হিসেবে পরিচিত এই করিডরের ফলে নেপাল ও ভুটানসহ এ অঞ্চলের সব দেশের জনগণ লাভবান হবে।
স্বল্প সময়ে চীনের দ্রুত অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নতির প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, চীনের সাম্প্রতিক উন্নয়নে তিনি অভিভূত। চীন থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার রয়েছে।
ওই সময় সিআইআইএসের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাবেক কূটনীতিক রুয়ান জংঝে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে শেখ হাসিনার অঙ্গীকারের প্রশংসা করেন।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর মেয়াদকালে বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের সাফল্য এবং বাংলাদেশ-চীন ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্বের ওপর আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মূল্যবোধের অংশীদারিত্ব এবং প্রাচীনকাল থেকে ব্যবসা ও ভ্রমণের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে চীনের যেসব ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করতে আগ্রহী আমরা তাদের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করব।’ চীনও বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের জন্য একই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
চীনকে সহযোগিতার অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোনো আদর্শিক ও আঞ্চলিক পক্ষপাত ছাড়াই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। বাংলাদেশ ও চীন উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর স্বার্থে কার্যকর যেকোনো ইস্যুকে পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে আসছে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীন-বাংলাদেশ সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে সংস্কৃতি, শিল্প ও কৃষি, পানিসম্পদ, বন্যা পূর্বাভাস, ভূমিকম্প সতর্কবার্তা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা এবং জননিরাপত্তা পর্যন্ত এ সহযোগিতা বিস্তৃত। তিনি তাইওয়ান ও তিব্বত ইস্যুতে ‘এক চীন নীতি’র প্রতি বাংলাদেশের দৃঢ় সমর্থনের কথা জানান।
আজ মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের শেষ দিন। আজই তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবেন।