গ্রাম্য মাতবরদের চোখ রাঙানির দিন শেষ, বদলে গেছে জীবনচিত্র

সমুদ্র হক ॥ উত্তরাঞ্চলের কোথাও এখন আর এক ফসলি জমি নেই। পতিত জমির পরিমাণও কমে গেছে। গ্রামের সাধারণ ক্ষুদ্র কৃষক যে কোন সূত্রেই যতটুকু জমি পেয়েছে, তাই কাজে লাগাচ্ছে। গ্রামে যারা এখনও জোতদার হয়ে আছে, তারাও জমি ফেলে রাখছে না। জমি পত্তন দেয়ার হার বেড়ে গেছে। যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে বাসাবাড়ি করেছে তারাও নিজেদের জমি পত্তন দিয়ে আসছে। পাকা সড়ক যোগাযোগ নিভৃত গ্রামে পৌঁছে যান্ত্রিক যানবাহন বেড়ে গিয়ে দূর কে করেছে অতি নিকট। এভাবে এতকালের অদৃশ্য কৃষিসম্পদ দৃশ্যমান হয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। মাঠপর্যায়ে গেলে যা খালি চোখেই দেখা যায়। অর্থনীতির বলয়ের প্রভাব পড়েছে সমাজ জীবনে। একটা সময় গ্রামের যে মাতবররা শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কলকাঠি নেড়ে ছড়ি ঘোরাত কৃষকের পিঠে, তারও পরিবর্তন হয়েছে। গ্রামে শিক্ষিতের হার বেড়ে যাওয়ায় এবং তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তির দ্রুত অপার প্রসারে গ্রামীণ কুটিল রাজনীতির (যা ভিলেজ পলিটিক্স নামেই অধিক পরিচিত) থাবা দুর্বল হয়ে ধীরে ধীরে দূর হয়ে যাচ্ছে। মাতবরের অন্যায় প্রস্তাব ও চোখ রাঙানি থোরাই কেয়ার করে। একটা সময় শহুরে মানুষের জীবন ধারা যেমনটি ছিল, বর্তমানে গ্রামে সেই ধারারই বিকাশ ঘটেছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) কল্যাণে পাকা সড়ক প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছার সঙ্গে যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। পাকা সড়কের মোড়গুলোতে (জংশন) বাসস্ট্যান্ড হওয়ায় আশপাশে সিএনজিচালিত অটোরিক্সা, ব্যাটারিচালিত গাড়ি, শ্যালো ইঞ্জিনচালিত যানগুলো যাত্রী বহন করে। এ সব পয়েন্টে আধুনিক মার্কেট ও খাবার দোকান নির্মিত হয়েছে। যে সব দোকানের ফ্রিজে সফট ড্রিংক আইসক্রিম মেলে। কসমেটিক্স টিস্যু পেপার ও ফাস্ট ফুডও মেলে গ্রামের মার্কেটে। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের যে কোন জেলা শহর থেকে কেউ যদি মনে করে প্রত্যন্ত কোন গ্রামে যাবে, তাহলে দুই আড়াই শ’ টাকায় সিএনজিচালিত অটোরিক্সা রিজার্ভ করে যেতে পারবে। এমন কি নদী তীরের গ্রামে এবং চরগ্রামে যাওয়া কোন কঠিন বিষয় নয়। যেমন বগুড়া শহর থেকে যমুনা তীরের সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলা সদরে দ্রুত যাওয়ার জন্য সিএনজিচালিত অটোরিক্সা দিনভর ও রাতের অনেকটা সময় ধরে চলাচল করে। কখনও অল্প দূরত্বের নিকটতম জেলা শহরেও চলাচল করে। গ্রামের আরও ভেতরে যাওয়ার জন্য শ্যালো ইঞ্জিনচালিত যানবাহন (যা নছিমন ও ভটভটি নামে পরিচিত) আছে। যে কোন নির্বাচনের সময় এই নছিমন ভটভটি নির্বাচনী কাজের জিনিসপত্র ও লোকবল দ্রুত ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে দিচ্ছে এবং ভোট শেষে তা নির্দিষ্ট জায়গায় ফিরে আনছে। সরকারী একজন কর্মকর্তা বললেন, গ্রামীণ পাকা সড়ক হওয়ায় এবং যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করায় উন্নয়নের ধারা চলমান রাখা গেছে। গ্রামীণ এই সড়কগুলো থেকে বেইলি ব্রিজ পর্যায়ক্রমে তুলে গার্ডার (রড সিমেন্ট কনস্ট্রাকশন) ব্রিজ নির্মিত হচ্ছে। যেমন বগুড়া সারিয়াকান্দি সড়কে বাঙালী নদীর ওপর থেকে বেইলি ব্রিজ অপসারিত হয়ে গার্ডার ব্রিজ নির্মিত হয়েছে। বগুড়া ধুনট সড়কেও বড় গার্ডার ব্রিজ নির্মিত হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে মাছিরপাড়ায় বাঙালী নদীর ওপর ৩১০ মিটার দীর্ঘ গার্ডার ব্রিজ নির্মাণের ভিত্তিফলক স্থাপন করেছেন ওই আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মোঃ আব্দুল মান্নান। এর আগে সারিয়াকান্দি থেকে মোকমতলা হয়ে যে সড়ক নির্মিত হয়েছে, তা জাতীয় মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হলে ব্যবহার করে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছা যাবে। গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি কৃষিতে এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। উত্তরাঞ্চল এখন যন্ত্র ও কৃষি শৈলীতে রূপান্তরিত হয়েছে। গ্রামের কোন কৃষক এখন বলদের হালচাষ করে না। ক্ষুদ্র কৃষকও টিলার ভাড়ায় চাষ করে। ধান মাড়াই কাটাইয়ের জন্য কামলা-কিষানের দিন ফুরিয়ে আসছে। কম্বাইন্ড হারভেস্টর দিয়ে ধান জমিতে কেটে মাড়াই করে একেবারে বস্তায় ভরে কৃষকের ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। কিষান বধূরা সিদ্ধ শুকনো কাজ করার পর তা ভেঙ্গে চাল করার জন্য হাটেও যেতে হচ্ছে না। বাড়ির আঙিনায় ভ্রাম্যমাণ ধান ভাঙ্গানো যন্ত্র পৌঁছে সেই কাজও এগিয়ে দিয়েছে। গ্রামে এখন কুঁড়েঘর খুঁজে পাওয়া যায় না। একটা সময় উত্তরাঞ্চলের রুক্ষ ভূমির এলাকায় একটা ফসল হতো। এখন আমন-বোরো-আউশের পর পারলে আরও ফসল ফলায়। একটি ফসল ঘরে তুলে আরেক ফসলের মধ্যবর্তী সময়ে জমি পড়ে থাকে না। কোন না কোন আবাদ হয়-ই। সবজি আবাদ তো বাম্পারে পরিণত। বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মোকামতলা ফাঁসিতলায় কয়েক কিলোমিটারজুড়ে যে কলার হাট বসে তাতে মনে হবে দেশের তাবত কলা ফলেছে উত্তরাঞ্চলে। বর্তমানে বিদেশে সবজি রফতানি হওয়ায় কৃষকের আয় বেড়েছে। তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তির প্রসারে গ্রামের শিক্ষিত অনেক তরুণ-তরুণী নতুন ভাবনায় আউটসোর্সিং রোজগারেও প্রবেশ করেছে। গ্রামেও এখন ট্যাব, আইপড মোবাইল ফোন দেখা যায়। একটা সময় গ্রামের যে মাতবররা যে মোসাহেব (চামচা) তৈরি করে নিজেদের যা ইচ্ছা তাই চাপিয়ে দিত, আজ সেই অবস্থা নেই। গ্রাম উন্নয়নের ছোট্ট উদাহরণ- বগুড়ার নিভৃত গ্রাম শিবগঞ্জের আমতলি মডেল স্কুলের শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ গোল্ডেন পায়। ওই স্কুলে ভাষাসৈনিক বাহাউদ্দিন চৌধুরী পাঠাগার স্থাপিত হয়েছে। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক মীর লিয়াকত আলী গ্রামের সকল মানুষকে বই পড়ায় উৎসাহ দিয়ে পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। এর চেয়ে বড় উন্নতি আর কী হতে পারে…।