সম্ভাবনার সেরা দশে বাংলাদেশ

অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের সম্ভাবনাময় সেরা ১০টি দেশের তালিকায় ওঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম।

অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন ও সাউথ আফ্রিকা) রাষ্ট্রগুলোকে পেছনে ফেলে বিশ্বের যে ১০টি দেশ ওঠে আসছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ফ্রান্সের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। তবে এই অগ্রগতির ক্ষেত্রে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। আর তা হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবকাঠামো ও বিনিয়োগ সমস্যা। এগুলোই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ওই সম্ভাবনায়।
গত মার্চে এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ফ্রান্সভিত্তিক বাণিজ্যিক ঋণ ও বিমা গ্রুপ কোফেইস। সংস্থাটি তাদের গবেষণায় বলেছে, ১০ বছর ধরে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির পর ব্রিকসের ৫টি দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরে ব্রিকসের জিডিপি গত এক দশকের চেয়ে ৩ দশমিক ২ শতাংশে কমে যেতে পারে। একই সময়ে বাংলাদেশসহ সম্ভাবনাময় ১০টি দেশ তাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
ব্যবসায়িক পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে কোফেইসের গবেষণা প্রতিবেদনে সম্ভাবনাময় ১০টি দেশকে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম গ্রুপে রয়েছে পেরু, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া ও শ্রীলঙ্কা। ব্যবসায়িক পরিবেশ ভালো থাকায় এসব দেশগুলো দ্রুত এগিয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। দ্বিতীয় গ্রুপে রয়েছে বাংলাদেশ, কেনিয়া, তানজানিয়া, জাম্বিয়া এবং ইথিওপিয়া। বলা হয়েছে, দুর্বল ব্যবসায়িক পরিবেশের কারণে এসব দেশের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
সম্ভাবনা ও দুর্বলতা : ফ্রান্সভিত্তিক সংস্থাটির ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের সম্ভাবনার পাশাপাশি বেশকিছু চ্যালেঞ্জের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভাবনার যে দিকগুলো উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- সস্তা শ্রমের কারণে পোশাক খাতে সক্ষমতা, শক্তিশালী রেমিট্যান্স আয়, আন্তর্জাতিক সহায়তা ব্যবহারে সক্ষমতা, সীমিত অভ্যন্তরীণ ঋণ এবং জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ কিশোর (যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে)। অন্যদিকে দুর্বলতাগুলো হচ্ছে- বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বস্ত্র খাতের উন্নয়ন করতে না পারা, মাথাপিছু স্বল্প আয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, দুর্বল ব্যবসায় পরিবেশ, অবকাঠামো সমস্যা এবং সাইক্লোন ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
সংকটেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বাংলাদেশ : ২০১৩ সালে ভবন ধস ও কারখানায় অগি্নকাণ্ডে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাক শিল্প ঝুঁকিতে পড়লেও তা কাটিয়ে ওঠে দেশটির শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত বছরের এপ্রিলে একটি ভবন ধসে সহস্রাধিক শ্রমিক মারা যান। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা পোশাক খাতের ঝুঁকির বিষয়টি বিশ্বের সামনে ওঠে আসে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে দেওয়া জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে দেয়। উপরন্তু দেশটির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে লাগাতার ধর্মঘট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকে অনেকটা স্থবির করে দেয়। তবে তা দেশটির সরকার কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। শ্রম পরিবেশ উন্নয়নে কাজও করছে দেশটির সরকার।
নির্বাচন-পরবর্তী অন্য বাংলাদেশ : অর্থনৈতিক অগ্রগতির যে ধারা তা চলতি বছরও (২০১৪) স্থিতিশীল থাকবে বলে মনে করছে ফ্রান্সভিত্তিক আর্থিক সংস্থাটি। কোফেইস বলছে, গত জানুয়ারিতে সফলভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসছে। উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোজোনের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর কারণে দেশটির পোশাক খাত নির্ভর রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে। শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং অর্ধেক কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ায় অভ্যন্তরীণ ভোগ ও চাহিদা আরও চাঙ্গা হবে। ২০১১ সালে যে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ছিল দুই বছরের মধ্যে তা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার মান যাতে খুব বেশি না বাড়ে সে লক্ষ্যে প্রচুর ডলার তুলে নিচ্ছে বাজার থেকে। বৈদেশিক ঋণও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আইএমএফের কাছ থেকে শর্তযুক্ত ঋণ নেওয়ায় ব্যাংকিং খাতে সংস্কার অব্যাহত রয়েছে।
ঝুঁকি : এসব সম্ভাবনার মধ্যেও কিছু ঝুঁকি বা আশঙ্কার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ঘাটতি, ডলারের বিপরীতে টাকার মান বৃদ্ধি এবং সাম্প্রতিক বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে রপ্তানি খাতে সক্ষমতা কিছুটা কমেছে। উপরন্তু মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে সৌদি আরবে শ্রম রপ্তানি বন্ধ থাকার পাশাপাশি অনেক প্রবাসী বাংলাদেশিকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে ২০১৩ সালে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। চলতি বছর এটি অব্যাহত থাকলে চাহিদা ও ভোগে চাপ পড়তে পারে। এদিকে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি নিচের দিকে থাকলেও খাদ্যপণ্যে সেটি বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বললেন : ফরাসি এই গবেষণা প্রতিবেদনটিকে সমর্থন করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে সেটির সুফল পাওয়ার জন্য দরকার দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যারা সুশাসন নিশ্চিত করতে সক্ষম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ আলী তসলিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গবেষণায় যে সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে এগুলো আমাদের জন্য নতুন নয়। কিন্তু সুশাসনের অভাবে আমরা এর সুফল পাচ্ছি না। তিনি বলেন, শুধু অর্থনীতি নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো নিশ্চিত হলে অর্থনীতি এমনিতেই এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস)-এর রিসার্স ডিরেক্টর ড. জায়েদ বখ্ত বলেন, তারা যে প্রতিবেদনটি করেছে সেটি ঠিক আছে। কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও অর্থনৈতিকভাবে আমাদের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। সামাজিক ক্ষেত্রেও আমাদের অনেক অগ্রগতি রয়েছে। বিশেষ করে সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ সঠিক পথে রয়েছে। তবে এ সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব। যদি প্রতিটি ক্ষেত্রে সুশাসন কায়েম করা যায় তবে আমাদের যে দুর্বলতাগুলো রয়েছে সেগুলো দূর করতে সময় লাগবে না। আর তখনই অর্থনীতির সুফল ঘরে তোলা যাবে।