গিনেস রেকর্ডে লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা…

লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলাকে স্বীকৃতি দিল গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস। বুধবার বাংলাদেশ সময় বিকেলে এই স্বীকৃতির কথা জানানো হয় গিনেসের ওয়েবসাইটে।
সবচেয়ে বেশি মানুষের অংশগ্রহণে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার নতুন রেকর্ড- এই শিরোনামে দেয়া ঘোষণায় বলা হয়েছে- ২ লাখ ৫৪ হাজার ৫৩৭ অংশগ্রহণকারী গত ২৬ মার্চ ঢাকার জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সঙ্গীত একসঙ্গে গেয়ে এই রেকর্ড গড়েছে।
নতুন রেকর্ডের পরিকল্পনা ॥ লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন রেকর্ড গড়ার পরিকল্পনা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ হয় জিওসি মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীর।
একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, যেদিন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বাংলাদেশের মানবপতাকা স্থান পেল, সে রাতে আনুমানিক আটটার দিকে প্রধানমন্ত্রী আমাকে ফোন করে অভিনন্দন জানালেন। তিনি ভীষণ আনন্দিত ও আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন, ‘এখানেই আমরা থামব না…।’ এর পর তিনি শেখ রেহানার সঙ্গে কথা বলতে বললেন। প্রধানমন্ত্রী তখন শেখ রেহানাকে ফোনটি দিলেন। তিনি (শেখ রেহানা) আমাকে বললেন, ‘আমরা এগিয়ে যাব এবং ২৬ মার্চ আরও একটি রেকর্ড গড়ব। সেটি হচ্ছে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ নিয়ে সবচেয়ে বড় রেকর্ড। আমরা থাকব। এর পর আমি প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, আমরা প্রস্তুত। আপনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। জনগণকে নিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব। তার মানে পরিকল্পনা কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিয়েছেন।
লক্ষ্য ছিল জাতীয় ঐক্য ॥ কেবল রেকর্ড গড়ার জন্যই গত ২৬ মার্চ একযোগে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার এই আয়োজনটি ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাঁর বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যে বলেছেন, এই আয়োজনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য জাতীয় ঐক্য।
মহান স্বাধীনতা দিবসে দেশপ্রেমী সকল মানুষকে একটি বিষয়ে সম্পৃক্ত করা, এক জায়গায় নিয়ে আসা, যেখানে কারও আসতে কোন বাধা থাকবে না। কাউকে আসার জন্য চাপ দেয়া হবে না, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ ছুটে আসবে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াবে, এক জায়গায় এক থিম নিয়ে নানা মতের, পথের, ধর্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইবে। এই কথা বলেছিলেন মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীও।
২৬ মার্চ সেই দিন ॥ ২৬ মার্চ বুধবার জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ভারতের পুরোনো রেকর্ড ভাঙ্গে বাংলাদেশ। বুধবার সকাল সাড়ে ছয়টায় খোলা হয় প্যারেড গ্রাউন্ডের প্রবেশদ্বার। স্বাধীনতা দিবসের প্রথম প্রভাতে পায়ে পায়ে হাজারো মানুষ প্রবেশ করতে থাকেন প্যারেড গ্রাউন্ডে। উদ্দেশ্য একটাই ‘জাতীয় সঙ্গীত গাইব, বিশ্ব রেকর্ড গড়ব।’
প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে আসতে থাকে জনতা, পুরো প্যারেড গ্রাউন্ড ছাপিয়ে আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা পরিণত হয় জনসমুদ্রে।
বেলা ১১টা ২০ মিনিটে ক্ষণগণনা শেষে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের মূল মঞ্চে দেশবরেণ্য শিল্পীদের কণ্ঠে সুর ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি…’। পরম আবেগে নিজেদের কণ্ঠে প্রাণের এ সঙ্গীতের সুর তোলেন পুরো গ্রাউন্ডজুড়ে সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে থাকা অংশগ্রহণকারীরা। একস্থানে আড়াই লাখ কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীতের সুর অন্যরকম আবহ তৈরি করে প্যারেড গ্রাউন্ডে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, গার্মেন্টস শ্রমিক, পরিবহন সংশ্লিষ্টসহ সর্বস্তরের মানুষ এতে অংশ নেন। সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ আয়োজন নিয়ে টানা কয়েকদিন ধরে সম্পন্ন হয় সব প্রস্তুতি।
প্যারেড গ্রাউন্ডে এসে জাতীয় সঙ্গীতের সুরে কণ্ঠ মেলান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যসহ সশস্ত্র বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা।
মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করাই ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’ আয়োজনের মূল লক্ষ্য থাকলেও সে লক্ষ্য ছাপিয়ে নতুন মাত্রা পায় বিশ্ব রেকর্ডের খাতায় বাংলাদেশের নাম ওঠার মাধ্যমে।
আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পালা ॥ ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’ আয়োজন শেষে অনুষ্ঠানের ভিডিও দেখে দুই সপ্তাহের মধ্যে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষ রেকর্ডের বিষয়ে জানাবে বলে ওইদিনই জানিয়েছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তার সেই ঘোষণা সত্যে পরিণত করে দুই সপ্তাহ পরই ৯ এপ্রিল বুধবার বাংলাদেশ সময় বিকেলে এই স্বীকৃতির কথা জানানো হয় গিনেসের ওয়েবসাইটে।
এর আগে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার বিশ্ব রেকর্ড তৈরি করে ভারত। গত বছরের ৬ মে একসঙ্গে ১ লাখ ২১ হাজার ৬৫৩ ভারতীয় নাগরিক ‘জনগণমন..’ গেয়ে গিনেস রেকর্ডে নাম লেখান।
২৬ মার্চ সকাল ৯টার আগেই ভারতের রেকর্ডটি ভেঙ্গে ফেলে বাংলাদেশ। ৮টা ৫৫ মিনিটে মূল মঞ্চ থেকে ঘোষণা দেয়া হয় ১ লাখ ৬০ হাজার লোক জমায়েত হয়েছেন প্যারডে গ্রাউন্ডে। ৯টা ১২ মিনিটে জমায়েত হয় ১ লাখ ৮০ হাজার আর ৯টা ৫০ মিনিটে ঘোষণা দেয়া হয় ২ লাখ ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ১০টায় ঘোষণা দেয়া হয় ২ লাখ ১৫ হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছেন জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে। সোয়া ১০টায় উপস্থিতি ছিল ২ লাখ ২৭ হাজার। ১০টা ৪০ মিনিটের আড়াই লাখ মানুষের ঘোষণা আসে মঞ্চ থেকে। জাতীয় সঙ্গীত শুরুর আগে আগে সোয়া ১১টায় ডিজিটাল কাউন্টিং মেশিনে উপস্থিতির সংখ্যা দেখানো হয় ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬৮১ জন।
মূল গ্রাউন্ডে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৫৩৭ জন অংশ নিলেও ন্যাশনাল প্যারেড গ্রাউন্ড ও তার আশপাশের এলাকাজুড়ে প্রায় পাঁচ লাখ আর গোটা দেশ এবং দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশ থেকেও সেদিন একযোগে জাতীয় সঙ্গীতে অংশ নেয় কোটি কোটি মানুষ।