বছরখানেক আগে প্রবাসীরা এক ডলার পাঠালে দেশে তাঁর স্বজনরা ৮০ থেকে ৮১ টাকা পেতেন। এখন পান ৭৭ থেকে ৭৮ টাকা। ডলারের এই দরপতনের ফলে তাঁদের অনেকে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। কেননা হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ ও ঝামেলা- দুটোই কম। এ অবস্থায় বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমানোর পাশাপাশি প্রণোদনার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করেছেন এ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এতে বছরে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স বাড়বে বলে আশা করছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশে এক হাজার ৪৭ কোটি ৯৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল এক হাজার ১১২ কোটি ১৩ লাখ ডলার। অর্থাৎ রেমিট্যান্স কমেছে ৬৪ কোটি ১৮ লাখ ডলার বা ৫.৭৭ শতাংশ। অথচ ২০১২-১৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১২.৬০ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরেও এ খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশের ওপরে।
অন্যদিকে ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেইনিংয়ের (বিএমইটি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মহাজোট সরকারের গত মেয়াদে ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ২৪ লাখ ৫১ হাজার ৯৩ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে চার লাখ ৯০ হাজার জন কর্মী বিদেশে গেছেন। যেখানে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রতিবছর গড়ে দুই লাখ ৬৫ হাজার ৭৬৫ জন কর্মী বিদেশে গেছেন।
জনশক্তি রপ্তানি বাড়ার পরও রেমিট্যান্স কমার কারণ জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খোন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জনশক্তি রপ্তানি ভালো থাকার পরও রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে; কেননা ডলারের দর পড়ে গেছে। এ কারণে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে (হুন্ডি) রেমিট্যান্স পাঠাতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। কেননা এখানে একটু বেশি পয়সা পাওয়া যায়।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স আসা কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি) সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ২০৪ কোটি ডলার। সেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ২৭০ কোটি ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে ১৭৩ কোটি ডলার। যেখানে গত অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এসেছিল ১৯৪ কোটি ডলার। কাতার ও কুয়েত থেকেও কমেছে রেমিট্যান্স। সামগ্রিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৪৪ কোটি ডলার। যেখানে গত অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এসেছিল ৬৩২ কোটি ডলার। তা ছাড়া যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুর থেকেও রেমিট্যান্স আসা কিছুটা কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দাবি করেন, সম্প্রতি সৌদি আরবে আকামা (পেশা) পরিবর্তনের জন্য সেখানকার কর্মীদের একটি বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। যে কারণে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স আসা কিছুটা কমেছে।
বিএমইটির সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বিগত বছরের তুলনায় গত বছর জনশক্তি রপ্তানি কমেছে। ২০১৩ সালে চার লাখ ৯ হাজার ২৫৩ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। যেখানে ২০১২ সালে গেছেন ছয় লাখ সাত হাজার ৭৯৮ জন কর্মী। তা ছাড়া চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৯৬ হাজার কর্মী বিদেশে গেছেন, যা অন্যান্য সময়ের তুলানায় কিছুটা কম। তবে এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী বলেন, দেশ থেকে গিয়েই কোনো কর্মী টাকা পাঠাতে শুরু করেন না। সাম্প্রতিক সময়ে যদি জনশক্তি রপ্তানি কমেও তবে সেটা এই মুহূর্তেই রেমিট্যান্সে প্রভাব ফেলার কথা নয়।
তবে হুন্ডির কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স আসা কমেছে বলে মনে করছেন না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ‘বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল’ উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হুন্ডি খুব একটা হচ্ছে বলে তাঁদের মনে হয় না। কেননা হুন্ডি এখন অনেক বেশি ঝুঁকিপুর্ণ।
এদিকে বিদেশে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন- এমন অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডলারের দর পড়ে যাওয়ার কারণেই তাঁরা রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহ পাচ্ছেন না। এমনই এক প্রবাসী বাংলাদেশি কুমিল্লার মোহাম্মদ উল্লাহ। ১৮ বছর ধরে তিনি সৌদি আরবে চাকরি করছেন। সম্প্রতি দেশে এসেছেন স্ত্রীর অপারেশনের জন্য। যোগাযোগ করা হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘সৌদি আরব থেকে এক রিয়াল পাঠালে দেশে ২০ টাকারও কম দেয়। আগে ২১ টাকার বেশি পাওয়া যেত। এভাবে রেট পড়ে গেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর আগ্রহ থাকে না।’
এদিকে বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ বেশি থাকায় অনেক ব্যাংক রেমিট্যান্স আনতে চাচ্ছে না বলেও জানা গেছে। একাধিক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে আমদানি ব্যয় কমা ও রপ্তানি আয় বেড়ে যাওয়ার বিদেশি মুদ্রার প্রবাহ বেড়ে গিয়েছিল। তখন কোনো কোনো ব্যাংকের ডলার ধরে রাখার সীমাও (নিট ওপেনিং পজিশন) কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরও অনেক ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত ডলার জমা হওয়ায় তা বাধ্য হয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জমা দিয়ে দেয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বিপরীতে নগদ টাকা দেয়নি, দিয়েছে বিল। যেগুলো পরিপক্ব হতে তিন থেকে ছয় মাস সময় লাগে। রেমিট্যান্স বাড়াতে ডলারের বহুমুখী প্রবাহ বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান আলী রেজা ইফতেখার। তিনি বলেন, ‘একটা ব্যাংকের ডলারের প্রয়োজন হয় এলসির পাওনা পরিশোধের জন্য। আমদানি কমে গেলে ডলারের চাহিদাও কমে যায়। তখন ডলারের দরও তর তর করে কমতে থাকে। ডলারের দর কমে গেলে রেমিট্যাররাও দেশে টাকা পাঠাতে চান না।’
প্রবাসী আয়ের ওপর প্রণোদনার প্রস্তাব : রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে প্রবাসী আয়ের ওপর প্রণোদনা চালু করা প্রয়োজন বলে মনে করেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘ফিলিপাইন, ভারত, পাকিস্তানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর ওপর নানা ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো প্রণোদনা দেওয়া হয় না। বরং বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য বেশি খরচ হয়।’
ইঞ্জিনিয়ার খোন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘পোশাক খাত যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনে, এর একটি বড় অংশ আবার চলেও যায়। সে হিসেবে রেমিট্যান্স থেকে অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসে। পোশাক খাতের জন্য যে পরিমাণ প্রণোদনা দেওয়া হয়, এর তুলনায় সামান্যতম প্রণোদনা দিলেই অবৈধ পথে টাকা পাঠানো কমে যাবে। ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স বাড়বে।’
তাঁর মতে, অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের সঙ্গে ব্যাংকিং চ্যানেল প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না। কারণ ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আনার খরচ বেশি। তিনি বলেন, ‘বিদেশে গিয়ে যাঁরা কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করছেন, তাঁরা যে চ্যানেলে বেশি সুবিধা পাবেন, স্বাভাবিকভাবে সেই চ্যানেলের মাধ্যমেই টাকা পাঠাতে উদ্বুদ্ধ হবেন। এই অবস্থায় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবশ্যই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে রেমিট্যান্স কোনোভাবেই বাড়ানো সম্ভব হবে না।’
বিদেশে যাওয়ার খরচ অনেক কমেছে উল্লেখ করে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী বলেন, ‘আগে কাজের জন্য মালয়েশিয়ায় যেতে তিন লাখ টাকা লাগত। এই সরকারের আমলে সেটা কমিয়ে ২৭ হাজার টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। আগে সৌদি আরবে যেতে যেখানে ১০ লাখ টাকা লাগত, সেখানে এখন লাগছে ১৭ হাজার টাকা। এমন যুগান্তকারী সাফল্য বাংলাদেশে আর কেউ কখনোই দেখাতে পারেনি। এর পরও রেমিট্যান্স কমার কোনো কারণ থাকতে পারে না।’