১৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে হাজার কোটি টাকা আয়ের স্বপ্ন!

হিটলার এ. হালিম
আউটসোর্সিং আয়ের (তথ্যপ্রযুক্তি খাত) জন্য দেশে ৫৫ হাজার ফ্রিল্যান্সার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় (আইসিটি)। এজন্য মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পাচ্ছে ১৮০ কোটি টাকা। এই টাকা ব্যয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ ফ্রিল্যান্সার তৈরি করে ২ বছর পরে মন্ত্রণালয় ১ হাজার কোটি টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখছে। তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন এই স্বপ্ন অবাস্তব। তাদের যুক্তি, ফ্রিল্যান্সিংয়ে দৃশ্যমান কিছু প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। আমাদের দেশের তরুণদের পক্ষে তা কাটিয়ে ওঠা বেশ কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ। এসব বাধা দূর করা গেলেই তবে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে। এদিকে ফ্রিল্যান্সারদের প্রশিক্ষণের জন্য আইসিটি মন্ত্রণালয় ৩০৫ কোটির বেশি টাকা চায় সরকারের কাছে। পরিকল্পনা কমিশন এ দাবিকে অস্বাভাবিক বলে ১৮০ কোটি টাকা দেয়া যেতে পারে বলে মত দেয়। পরে আইসিটি মন্ত্রণালয় ‘রিভাইজড’ প্রস্তাবনা জমা দিলে ১৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এই টাকার একটা বড় অংশ অপচয় হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে কমিশন। ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণের জন্য (ইন্টারনেট থেকে আয়ের পদ্ধতি সহজে যাকে আউটসোর্সিংও বলা হয়) আইসিটি মন্ত্রণালয় ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য ৩০৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়ে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রস্তাব পাঠায় আইসিটি মন্ত্রণালয়। এরপর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় খাতভিত্তিক কার্যক্রম ও ব্যয় পর্যালোচনা করে ১২৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হিসেবে চিহ্নিত করে। এ প্রকল্পের বিপরীতে ১৮০ কোটি ৪০ লাখ টাকার বেশি অর্থ বরাদ্দ দিতে রাজি হয়নি পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ।
এ বিষয়ে জানতে আইসিটি সচিব নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা যা চেয়েছি সেই পরিমাণ টাকাই বরাদ্দ পেয়েছি। এই টাকা ব্যয় করে আমরা দুই বছর পর ১ হাজার কোটি টাকা আয় করে দেখাব।
তিনি উল্লেখ করেন, গত বছর ফ্রিল্যান্সিংয়ে আমাদের দেশের তরুণরা আয় করেছে ৪-৫ কোটি ডলার। এর আগের বছর আয় করেছে ২ কোটি ডলারের মতো। দিন দিন আয়ের পরিমাণ বাড়ছে। ফ্রিল্যান্সারদের প্রশিক্ষণ দিতে পারলে আয়ের লক্ষ্যমাত্রায় (১ হাজার কোটি টাকা) পৌঁছানো সম্ভব হবে।
তবে লক্ষ্য অর্জনের পথে কয়েকটি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে উল্লেখ করে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ইংরেজিতে দুর্বলতা আউটসোর্সিং আয়ের ক্ষেত্রে বড় বাধা। তরুণরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশের ভাষার ‘একসেন্ট’ পুরোপুরি বুঝতে ব্যর্থ হওয়ায় আমাদের দেশে কলসেন্টারগুলো ব্যবসা আনতে পারছে না। এ বাধা কাটিয়ে উঠতে পারলে তরুণদের আয়ের পরিমাণ বাড়বে।
প্রতিবন্ধকতা দূর করতে নজরুল ইসলাম খান দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি কম্পিউটার ল্যাব এবং ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে জানান। তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে।
লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, আইসিটি মন্ত্রণালয়ের পাঠানো প্রস্তাবের কয়েকটিতে আপত্তি জানায় পরিকল্পনা কমিশন। ফ্রিল্যান্সারদের প্রশিক্ষণে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞাপন প্রচার, মেলার আয়োজন, গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শক নিয়োগ, অনলাইন সাপোর্ট সার্ভিসের ব্যবস্থাপনা খরচ, স্থানীয় ও বৈদেশিক কর্মশালা-সম্মেলন-বিদেশ ভ্রমণ খাতে অস্বাভাবিক ব্যয় ধরা হয়েছে। মন্তব্যে এসবের কোনো প্রয়োজন নেই বলে উল্লেখ করেছে কমিশন। পরিকল্পনা কমিশনের ধারণা, কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়েছে।
আইসিটি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৫৫ হাজার দক্ষ ফ্রিল্যান্স্যার তৈরি হবে। মন্ত্রণালয়ের দাবি, বিশ্ব বাজারে ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং বিষয়ে সচেতনতা ও নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিংয়ের কার্যক্রম তৃণমূল পর্যায়ে সম্প্রসারণ করতেই এই পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন রয়েছে।
জানা গেছে, এই প্রকল্পের আওতায় ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ফ্রিল্যান্সারদের প্রশিক্ষণ ও সেমিনার বাবদ ১৮০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ ধরে এটি অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এর আগে তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণের নামে যেসব প্রকল্পে বরাদ্দ হয়েছিল তা যথার্থ কাজে লাগেনি। অনভিজ্ঞ প্রশিক্ষক দিয়ে দায়সারা গোছের প্রশিক্ষণ দেয়ারও অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। তাদের অভিমত, দেশের প্রায় ১ লাখ তরুণ-তরুণী ফ্রিল্যান্সার আউটসোর্সিং খাতে যে আয় করছেন তাদের বেশিরভাগই নিজ যোগ্যতার ভিত্তিতে এবং দেশে বসেই।
এ ধরনের প্রকল্প হাতে নেয়ার আগে যেসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে সেগুলো মূল্যায়নের পক্ষে মত দিয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। মূল্যায়নের ফল ইতিবাচক হলেই তবে এ প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে বলে তারা মনে করছেন।