মনি মাহমুদ : কৃষি খাতে অর্জনের ক্ষেত্রে কেবল ২০১৩ সালকে আলাদা করলে অগ্রগতির পুরো প্রক্রিয়া অনুধাবন কঠিন হবে। গত এক দশকে বাংলাদেশের কৃষি খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। ২০১৩ সালেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এবার বেড়েছে সামগ্রিক উৎপাদন। মাঠে এসেছে নতুন প্রযুক্তি। ফলে চিত্রটাই পাল্টে গেছে। কৃষকের মুখের হাসি এখন আরো উজ্জ্বল।
কৃষি খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দানাদার খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য এখন বিশ্বজোড়া। এ দেশের কৃষি বিপ্লব বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে। গত কয়েক বছরের মতো ২০১৩ সালেও কৃষক কঠোর পরিশ্রম করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রায় সব ধরনের ফসলের বাম্পার ফলন নিশ্চিত করেন। ধান, গম, আলুসহ বিভিন্ন শাকসবজির বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা অনেকটা হতাশ। বছর শেষে বিপণন-ব্যবস্থাও কৃষকদের বেকায়দায় ফেলে দেয়। হরতাল-অবরোধে তারা ভীষণ ক্ষতির সম্মুখীন হন।
কৃষকদের বিপণন-ব্যবস্থা প্রসঙ্গে কৃষিবিদ দেলোয়ার জাহান বলেন, বাংলাদেশে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন যে-কোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি। কিন্তু অন্যান্য বছরের মতো ২০১৩ সালেও বিপণন-ব্যবস্থার দুর্বলতার ফলে কৃষককে ভোগান্তি পোহাতে হয়। উৎপাদনের তুলনায় এ দেশে বিপণন ব্যবস্থাটা অনগ্রসর। দুটোকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে না পারায় জাতীয়ভাবে অনেক ক্ষতি হচ্ছে।
জানা গেছে, এখন জাতীয় আয়ের প্রায় ২০ ভাগ আসে কৃষি থেকে। আমাদের শ্রমশক্তির প্রায় ৪৮ ভাগ কৃষি খাতে নিয়োজিত। দেশে নগরায়ণ দ্রুত বাড়লেও মোট জনগণের প্রায় ৭০ শতাংশ এখনো গ্রামাঞ্চলেই বসবাস করেন ও কোনো না কোনোভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। সেই হিসাবে জাতীয় আয়ের কমবেশি ৪৫ শতাংশ কৃষি খাত-সংশ্লিষ্ট। তাই কৃষি খাতে সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে আরো ত্বরান্বিত করেছে বলে মনে করছেন কৃষি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
উচ্চ ফলনশীল ফসলের আবাদ অন্যান্য বছরের মতো এবারো বেড়েছে। দেশের প্রায় শতভাগ জমি এখন উন্নত জাতের চাষের আওতায়। রাসায়নিক সারের তুলনায় জৈব সারের ব্যবহার বেড়েছে। সেচের আওতা সম্প্রসারিত হওয়ায় এবছর উৎপাদনও বেড়েছে। বিনামূল্যে ও ক্ষেত্রবিশেষে স্বল্পসুদে কৃষিবীজ পাওয়ায় কৃষকরা তার সুফল পাচ্ছেন।
বছরের শেষদিকে সরকার কৃষিক্ষেত্রে ইতিবাচক নতুন একটি সিদ্ধান্ত নেয়। এখন থেকে কৃষি ফসলের জন্য ৩১ ধরনের বীজ উৎপাদনে কৃষকরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন। ব্যাংক একরপ্রতি
৩ হাজার ৯৯৫ থেকে ৪ লাখ ৩ হাজার টাকা ঋণ দিতে পারবে। আগে শুধু ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষকরা ঋণ নিতে পারতেন। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শিগগির একটি সার্কুলার জারি করে ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দেবে বলে জানা গেছে।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, দানা শস্যের মধ্যে রোপা, আমন, বোরো, গম (সেচসহ), অর্থকরী ফসল পাট, মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে মরিচ, পেঁয়াজ (বাল্ব), রসুন, পেঁয়াজ (প্রকৃত বীজ); শাকসবজির মধ্যে শিম, লালশাক, পালংশাক, কলমিশাক, লাউ, মুলা, বরবটি, বেগুন, উচ্ছে, ঢেঁড়স, পুঁই, ডাঁটা এসব চাষে ব্যাংক ঋণ দেবে। এছাড়া আলু, তেল জাতীয় ফসলের মধ্যে সরিষা, সয়াবিন, চিনাবাদাম, সূর্যমুখী এবং ডালজাতীয় পণ্যের মধ্যে মুগডাল (খরিপ-১), মুগডাল (রবি), মাষকলাই, ছোলা, মসুর ও খেসারি বীজ উৎপাদনের জন্য ঋণ নেয়া যাবে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে পাট, মরিচ, পেঁয়াজ (প্রকৃত বীজ), শাকসবজি ও সূর্যমুখী ফসলের জন্য সর্বোচ্চ এক একর এবং আলু ফসলের জন্য সর্বোচ্চ আড়াই একর জমিতে ঋণ দেয়া যাবে। এছাড়া অন্যান্য ফসলের বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ একর পর্যন্ত ঋণ দেয়া যাবে। কৃষকরা এসব ঋণ পরিশোধে ফসল সংগ্রহের পর আরো ৬ মাস পর্যন্ত সময় পাবেন। ব্যাংকগুলোকে বীজ উৎপাদনের খরচ নির্ধারণে সুষম সার, বীজ, সেচ, মাচা, কীটনাশক, জমি তৈরি যান্ত্রিক, শ্রম, মৌসুমওয়ারি ফসল উৎপাদনে জমির ভাড়া, পাতলাকরণ, পরিবহন খরচ, বীজ শোধন ও বীজ সংরক্ষণের ব্যয় অন্তর্ভুক্ত হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বীজ উৎপাদন কমে যাওয়ার প্রায় সব ধরনের বীজ আমদানি করা হচ্ছে। এ কারণে বীজ চাষে কৃষকদের উৎসাহী করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ উদ্যোগ নিয়েছে। গত আগস্ট মাসে আরো একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ নেয় সরকার। দক্ষিণাঞ্চল কৃষি খাতে অনুন্নত হিসেবে পরিচিত। কিন্তু প্রাকৃতিক উপাদানে পরিপূর্ণ ওই অঞ্চলকে সঠিক পরিকল্পনার আওতায় আনতে কৃষিক্ষেত্রে টেকসই এবং বৃহৎ উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি উন্নয়নে ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত একটি মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার মনে করছে, দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিতে আরো উন্নয়ন সম্ভব হলে তা জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখবে।
জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং টেকসই উন্নয়নে ১০ বছরে ২৬টি প্রোগ্রামের জন্য ৫ লাখ ৭৮ হাজার ২৬ মিলিয়ন টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ওই প্রকল্পের লক্ষ্য অর্জনে ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অরগানাইজেশনের (ফাও) সহায়তায় দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের নিয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা একযোগে কাজ করবে।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সম্পদের স্বল্পতাসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে আমরা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। এই অর্জন ধরে রাখতে হলে দেশের জনসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই হারে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। ওই প্রকল্পের আওতায় দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন হলে শুধু ফসল নয়, প্রাণী এবং মৎস্য উৎপাদনেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।