একই জমিতে বছরে চার ফসল আবাদ খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা একই জমিতে বছরে চার ফসল আবাদের প্যাটার্ন আবিষ্কার করেছেন। গত দুই বছর মাঠ পর্যায়ে এ ফসল আবাদ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ফলে আগামী বছর থেকে বিজ্ঞানীরা ব্যাপক ভিত্তিতে ফসল আবাদের এ প্যাটার্ন মাঠে নিয়ে যাচ্ছেন। 
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ পদ্ধতিতে মাঠে ফসল আবাদ হলে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এতে শুধু কৃষকই লাভবান হবে না, কৃষি খাতে কর্মসংস্থানও ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি দেশের মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা বেড়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক ড. রফিকুল ইসলাম ম-ল বলেন, দেশে কৃষি জমি কমছে, তার বিপরীতে জনসংখ্যা বাড়ছে। তাই বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। সেটি বাড়াতে হবে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ সৃষ্টি না করে। কারণ বরেন্দ্র অঞ্চলে বেশি পরিমাণে বোরো চাষের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। 
তিনি বলেন, ‘সেই বিবেচনাতেই আমরা গবেষণা করে একই জমিতে বছরে চার ফসল আবাদের প্যাটার্ন আবিষ্কার করেছি। গত দুই বছর আমরা দেশের ১৪টি স্থানে মাঠ পর্যায়ে এ প্যাটার্ন আবাদ পরীক্ষা করে সফল হয়েছি। এখন আগামী বছর থেকে এ প্যাটার্ন নিয়ে আমরা কৃষকের কাছে যাচ্ছি।’
ড. ম-ল বলেন, দেশের সব জমিতে চার ফসল আবাদ করা যাবে না। তবে বেশ কিছু জমিতেই চার ফসল আবাদ করা যাবে। বর্তমানে যেখানে বেশিরভাগ জমিতে দুই ফসল আবাদ হচ্ছে, সেখানে বেশির ভাগ জমিতে এ প্যাটার্নে তিন ফসল আবাদ করা যাবে। এতে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে। 
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গত ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশের ১৪টি স্থানে মাঠ পর্যায়ে এই চার ফসল আবাদের মডেল পরীক্ষা করে দেখেছেন। এতে দেখা যাচ্ছে, একই জমিতে বছরে স্বল্পমেয়াদী চারটি ফসল আবাদ করা সম্ভব। আর এতে ফসল আবাদের ঘনত্ব বর্তমান ১৯০ শতাংশ থেকে ৪০০ শতাংশে উন্নীত করা যায়। 
বিজ্ঞানীরা মাঠ পর্যায়ে তিনিটি ফসলের প্যাটার্ন পরীক্ষা করেছেন। এতে দেখা যায়, রোপা আমন-সরিষা-বোরো- রোপা আউশ, রোপা আমন- আলু- বোরো- রোপা আউশ এবং রোপা আমন- সরিষা-মুগ- রোপা আউশÑ ফসলের এই তিনটি প্যাটার্ন আবাদ করে আশাতীত ফলন পেয়েছেন। এতে হেক্টরপ্রতি ফলন দাঁড়িয়েছে ৩৪ টন। অথচ স্বাভাবিক অবস্থায় এসব জমিতে দুই ফসল আবাদ করা হয়। এতে বছরে ফলন পাওয়া যায় সর্বোচ্চ সাড়ে ১৪ টন। 
এই চার ফসল আবাদের মডেল প্রয়োগে কৃষকের লাভের অঙ্কটাও অনেক বেড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে দুই ফসল আবাদে যেখানে প্রতি হেক্টরে কৃষকের বিনিয়োগ হয় এক লাখ টাকা, আর তা থেকে রিটার্ন পাওয়া যায় দুই লাখ টাকা, সেখানে চার ফসল আবাদে দুই লাখ ৩৬ হাজার টাকা বিনিয়োগে রিটার্ন পাওয়া যায় পাঁচ লাখ টাকা। 
বর্তমানে দেশে আবাদী জমির পরিমাণ এক কোটি ৪৯ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে প্রকৃত আবাদী জমির পরিমাণ হচ্ছে ৭৮ লাখ ৪০ হাজার টন। এ আবাদী জমির মধ্যে চার ফসল আবাদ হয় নয় হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে, তিন ফসল আবাদ হয় ১৪ লাখ হেক্টর জমিতে, দুই ফসল আবাদ হয় ৪১ লাখ হেক্টর জমিতে এবং এক ফসল আবাদ হয় ২২ লাখ হেক্টর জমিতে। 
কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্তমানে খুব অল্প পরিমাণ জমিতে চার ফসল আবাদ হয়। অথচ বিদ্যমান তিন ফসলী জমিগুলোতে অনায়াসে চার ফসল আবাদ করা সম্ভব। আবার দুই ফসলী জমিগুলোতে তিন ফসল আবাদ করা সম্ভব। এতে আবাদী জমির পরিমাণও অনেক বেড়ে যাবে। 
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে এখন স্বল্পমেয়াদী উচ্চ ফলনশীল অনেক ফসলের জাত বের হয়েছে। এ মডেলে এগুলোই আবাদ করা সম্ভব। কোন্্ এলাকায় কোন্্ চার ফসল আবাদ করা সম্ভব সেটা ওই এলাকার ওপর নির্ভর করবে। তবে কোন্্ কোন্্ এলাকায় রোপা আমন-সরিষা-বোরো-রোপা আউশ আবাদ করা যাবে। আবার কোন্্ কোন্্ এলাকায় রোপা আমন-আলু-বোরো-রোপা আউশ আবাদ করা যাবে। আবার অন্য এলাকাগুলোতে রোপা আমন-সরিষা-মুগ-রোপা আউশ আবাদ করা যাবে। একেক এলাকার কৃষক একেক প্যাটার্ন পছন্দ করবে। 
এ প্রসঙ্গে ড. রফিকুল ইসলাম ম-ল বলেন, জুলাই মাস থেকে এ আবাদ শুরু হবে এবং জন মাসে গিয়ে শেষ হবে। প্রথম ফসল আমন দিয়ে শুরু হবে। এক্ষেত্রে বীনা-৭ ধান স্বল্পমেয়াদী একটি উচ্চ ফলনশীল জাত। আমরা কৃষকদের এ জাতটি আবাদ করার পরামর্শ দিচ্ছি। এ ছাড়া আলু, সরিষা, মুগেরও স্বল্পমেয়াদ উচ্চ ফলনশীল জাত বের হয়েছে। কৃষক সেগুলো আবাদ করতে পারে। তাহলে কৃষকের পক্ষে বছরে একই জমিতে চার ফসল আবাদ করতে কোন অসুবিধা হবে না। 
তিনি বলেন, ‘চার ফসল আবাদের ক্ষেত্রে একটি ফলন তোলার পর দ্বিতীয় সফল আবাদ করতে হবে চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই। তাহলে কৃষক সহজেই চারটি ফসল ঘরে তুলতে পারবে।’ 
জমির উর্বরতা প্রসঙ্গে ড. ম-ল বলেন, আউশ ধান কাটার সময় ৫০ শতাংশ গাছ জমিতে রেখে ওপর থেকে ধান কেটে নেবে। একইভাবে সরিষা বা মুগের গাছও জমিতে থেকে যাবে। ফসলের গাছের এই অবশিষ্টাংশ মাটিতে মিশে জৈবসার হবে। যা জমির মাটির জৈবসারের ঘাটতি পূরণ করবে। এ ছাড়া প্রতিটি সফলের জন্য যে পরিমাণ সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন, তাই প্রয়োগ করতে হবে। তা হলেই জমির উর্বরতা কমবে না বরং বেড়ে যাবে। 
তিনি বলেন, ‘এক লাখ হেক্টর জমিতে চার ফসল করা শুরু হলেই কৃষি উৎপাদনে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তখন বাড়তি লাভের আশায় কৃষকরাও আগ্রহী হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে দিনাজপুর জেলার চাষীরা এই চার ফসল আবাদে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। অন্যান্য এলাকার কৃষকও এ প্যাটার্নের ফসল আবাদে আগ্রহী হয়ে উঠছে।’
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্তমানে কৃষক বোরো ধানের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এটা কমাতে হবে। কারণ এত বোরো আবাদের মতো পানি পাওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে বোরো কমিয়ে আউশ আবাদ বাড়াতে হবে। চার ফসলের এ প্যাটার্ন কৃষকদের ফসল আবাদে বোরোর ওপর নির্ভরশীলতা অনেকাংশে কমিয়ে আনবে। যদিও প্রাথমিকভাবে চার ফসলের প্যাটার্নে বোরো এবং আমন উভয় ফসলই লাভজনক হয়েছে। তবে অন্য ফসল যখন লাভজনক হবে তখন কৃষক বোরোর পরিমাণ কমিয়ে দেবে। 
বর্তমানে আমাদের দেশে ডাল ও তেল জাতীয় ফসলের আবাদ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। এ প্যাটার্নের সফল আবাদে সেই ডাল ও তেল জাতীয় ফসল আবাদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।