রেকর্ড রিজার্ভে অর্থনীতিতে স্বস্তি
পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ২৭ শতাংশ
এম শাহজাহান ॥ পোশাক রফতানি বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্থনীতিতে নতুন স্বস্তি এনে দিয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পর দেশের পোশাক শিল্প নিয়ে যখন বিশ্বব্যাপী তুমুল সমালোচনা চলছে তখন ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে পোশাক রফতানি। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। যা স্বাধীনতার পর এই প্রথম ১ হাজার ৬০৩ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। রিজার্ভের এই পরিমাণ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান জানিয়েছেন, স্বাধীনতার পর রিজার্ভের এই পরিমাণ বাংলাদেশের ইতিবাচক অর্থনীতির বড় প্রমাণ। তেমনি আমাদের অর্থনীতি যে স্থিতিশীল ও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, এটি তারও প্রমাণ বহন করছে।
এছাড়া রিজার্ভ বাড়ায় স্বস্তি ফিরে এসেছে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও। আপাতত আমদানিতে আর ডলারের সঙ্কট হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই। এছাড়া রিজার্ভ বাড়ার ফলে দেশে নতুন করে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলেও তাঁরা মনে করছেন।
এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, রিজার্ভ বাড়ার তিনটি কারণ হচ্ছে, রেমিটেন্স বেশি আসা, রফতানি বৃদ্ধি এবং দেশীয় উৎপাদন ভাল হওয়ায় আমদানি হ্রাস পাওয়া। তিনি বলেন, দেশে উৎপাদিত সব ধরনের পণ্যমান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের হয়েছে। এর ফলে গত কয়েক বছরে রফতানি বেড়েছে, কমেছে আমদানি। ফলে রিজার্ভ শক্তিশালী হচ্ছে। তিনি বলেন, অর্থনীতিতে বর্তমান সরকারের কিছু ভাল সিদ্ধান্তের কারণে এমনটি হয়েছে। গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রফতানি পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে বেড়েছে। আর এ কারণে রেমিটেন্স কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, রিজার্ভ বাড়ায় উদ্যোক্তাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। আশা করছি, দেশে নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
এদিকে, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুসারে বস্ত্র খাতের নিট ও ওভেন মিলে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রফতানি আয় বেড়েছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক ১৩ শতাংশ। ওই সময়ে রফতানি আয়ের ৩০২ কোটি ডলারের মধ্যে পোশাক খাতের অবদান ২৫১ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই পরিমাণ ছিল ২০০ কোটি ডলারেরও কম।
এ প্রসঙ্গে বস্ত্র খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি (অর্থ) রিয়াজ-বিন-মাহমুদ সুমন জনকণ্ঠকে বলেন, রফতানি প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়ায় চলতি অর্থবছরে ৩০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে, তা অর্জন করা যাবে। বিশ্ব মন্দা সত্ত্বেও ও পোশাকের গুণগতমান এবং দাম কম হওয়ার কারণে ক্রেতারা আমাদের এখানে ছুটে আসছেন। রানা প্লাজা ধস, তাজরীন কারখানায় অগ্নিকা- এবং এ নিয়ে দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে সমালোচনা সত্ত্বেও বড় অঙ্কের রফতানি আয় প্রমাণ করে, বাংলাদেশী পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা বহির্বিশ্বে বেড়েছে।
তিনি বলেন, রফতানিকারক এবং শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নের ফলে এমনটা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে যে দেশই আমাদেশ সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে আসুক, তারা রাতারাতি আর কিছুই করতে পারবে না। তবে প্রতিযোগিতার ব্যাপারে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হলো ভারত।
আমরা চীন, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনামকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি না। ভারত ১২ বিলিয়ন ডলার থেকে বর্তমানে ১৮ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করছে। আর আমরা করছি ২২ বিলিয়ন ডলারের। ভারত সরকার তাদের পোশাক খাতকে গভীরভাবে পরিচর্যা করছে।
তথ্য মতে, চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের গত জুলাই মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় নিট (গেঞ্জি ও সোয়েটার) পণ্যের রফতানি আয় ২৩ শতাংশ বেশি হয়েছে। প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশেরও বেশি। ১০২ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এই পণ্যের রফতানি বেড়ে হয়েছে ১২৫ কোটি ডলার। ওভেনে (শার্ট, প্যান্ট) লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি আয় হয়েছে। এই পণ্যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৭ শতাংশেরও বেশি। ১১১ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বদলে আয় হয়েছে ১২৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ রফতানি আয় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে।
জিএসপি স্থগিতের প্রভাব পড়েনি পোশাক খাতে ॥ পণ্য রফতানিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জিএসপি বা শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা স্থগিতের কোন প্রভাব পড়েনি পোশাক খাতে। আর এ কারণে বস্ত্র খাতের রফতানি বাড়ছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও রফতানি হ্রাস পায়নি। যদিও পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা বরাবরই বলে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা বাতিল হলে পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কখনও পোশাক রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যায়নি। বর্তমান ওই দেশে ১৬ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পোশাক রফতানি হচ্ছে। তবে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা সব সময় অব্যাহত আছে। এ অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা বাতিল হয়েছে ঠিকই কিন্তু তৈরি পোশাক শিল্পে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
তবে চিংড়ি, জুট এবং হ্যান্ডিক্রাফটসসহ সমজাতীয় কয়েকটি পণ্যের রফতানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কারণ এ কয়েকটি পণ্য রফতানিতে জিএসপি সুবিধা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মোট রফতানিতে এ কয়েকটি পণ্যের অবদান ০.০৫ শতাংশ। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা স্থগিতের কারণে মোটেও উদ্বিগ্ন নয় দেশের পোশাক রফতানিখাতের উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার শুল্কমুক্ত বা বাজার সুবিধা বাতিল করলে পোশাক রফতানিখাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী জনকণ্ঠকে বলেন, জিএসপি সুবিধা বাতিলে পোশাক রফতানিকারকদের আতঙ্কের কিছু নেই। কারণ পোশাক রফতানি হচ্ছে শুল্ক দিয়েই। তবে একক দেশ হিসেবে পোশাক রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দ্বিতীয়। তাই এ বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার জরুরী।
তিনি বলেন, এ খাতের উদ্যোক্তাদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ তাঁরা শুল্ক দিয়েই ওই বাজারে পোশাক রফতানি করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত বা জিএসপি সুবিধা বাতিল করায় বিশ্বে একটি ভুল বার্তা পৌঁছে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু প্রতিযোগী সক্ষমতায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের বাংলাদেশে আসতে হবে। তিনি বলেন, স্বল্পমূল্যে এত ভালমানের পোশাক আর কোন দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে সরবরাহ করতে পারবে না।