বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ

স্বাধীনতার পর পর পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বাংলাদেশকে বলা হতো তলাবিহীন ঝুড়ি (বটমলেস বাস্কেট)। আর এখন বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির অপার সম্ভাবনার কথা। স্বাধীনতার পরবর্তী বছরের মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট চার দশক পর এসে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকায়। কৃষি, শিল্প, সেবা খাতে সব জায়গায় আশাতীত উন্নয়ন। গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে জিডিপির (মোট দেশজ উত্পাদন) প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি। এসব অগ্রগতিতে মূল অবদান দেশের সাধারণ মানুষের। কৃষক নিজ উদ্যোগে উত্পাদন বাড়িয়ে দেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ বিদেশে গিয়ে ১৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক অর্থ দেশে পাঠাচ্ছে। আর ৪০ লাখেরও বেশি নারী পোশাক কর্মী কাজ করে ১৭ বিলিয়ন ডলার আনছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের মধ্যে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ৫৮ শতাংশ। বিশ্বের আর কোনো দেশে এমন বয়স কাঠামো নেই। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় সব উন্নত দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমছে এবং বয়স্কের সংখ্যা বাড়ছে। এই বিশেষ সুযোগকে জনসংখ্যাভিত্তিক মুনাফা বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। অর্থনীতির ভাষায় কর্মক্ষম মানুষের পরিমাণ বাড়ার কারণে ভোক্তার তুলনায় উত্পাদনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়তে যেমন সহায়তা করে, তেমনি জাতীয় আয়ও বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এই কর্মক্ষম জনসংখ্যা বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ বয়ে আনতে পারে। এসব সাধারণ মানুষকে যদি প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানো যেত তাহলে রাতারাতি দেশের অর্থনীতি আরও বদলে যেত।

বর্তমানে জনশক্তি রফতানি খাত থেকে সবচেয়ে বেশি মুদ্রা আয় হয়ে থাকে। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি আয় পোশাক শিল্প খাতের আয়ের চেয়েও ৩ দশমিক ২ গুণ বেশি এবং ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট থেকে ১২ গুণ বেশি। ১২-১৩ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত শুধু ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় এসেছে ১২ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থবছর শেষে জুন পর্যন্ত এ আয় প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। তা টাকার অঙ্কে ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে হুন্ডি এবং ব্যক্তি আসার সময় নিয়ে আসা অর্থও এর কম নয়। পোশাক খাতে বছরে আসে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার-যার ৬০ শতাংশ ব্যয় হয় ওই খাতের কাঁচামাল আমদানিতে। সাম্প্রতিক আঙ্কটাডের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর রেমিট্যান্স আয় নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৪৮টি স্বল্পোন্নত দেশে যে রেমিট্যান্স আসে তার ৪৪ ভাগই আসে বাংলাদেশে।

এ প্রসঙ্গে রামরুর চেয়ারপারসন অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, আমাদের জনশক্তি খাতের সম্ভাবনার সামান্য যেটুকু কাজে লাগানো যাচ্ছে তাতেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত হয়ে আছে। বিশ্বায়নের এ সময়ে ৫৮ শতাংশ কর্মক্ষম জনশক্তি বাংলাদেশের সামনে বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এই গ্লোবাল অপরচুনিটি গ্রহণ করতেও চায়। তাই এ সুযোগ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যেসব বাধা আছে সরকারের উচিত সেগুলো দূর করা। তিনি বলেন, ১৬ কোটি মানুষের দেশে প্রতিবছর চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে মাত্র দুই থেকে আড়াই লাখ মানুষের। প্রতিবছর যে পরিমাণ শিক্ষার্থী শিক্ষা শেষে কাজে যোগদান করতে চাইছে তাদের তুলনায় কর্মের সুযোগের এই পরিসংখ্যান খুবই অপ্রতুল। এখন সরকার যদি উদ্যোগ নেয় বিশ্বের বাজার উপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, তাহলে রাতারাতি চিত্র পাল্টে যাবে।

সরকারি হিসেবে বর্তমানে প্রায় ৮৫ লাখের বেশি শ্রমিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। নিজ উদ্যোগে বা ব্যবসায়ীদের হাত ধরে যাওয়া এসব মানুষদের বেশিরভাগই অদক্ষ বা আধাদক্ষ। বাংলাদেশের শ্রমবাজার বেশিরভাগ মধ্যপ্রাচ্যমুখী, তবে এখন মালয়েশিয়াও কিছুটা দখল করেছে। ইউরোপ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাতেও দক্ষ জনশক্তির চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে সেসব দেশে লোক যেতে শুরু করেছে, কিন্তু সেটা একেবারেই সামান্য। অথচ এসব দেশে সেবা খাতসহ হোটেল ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে তথ্য-প্রযুক্তির বাজারে দক্ষ জনশক্তির বিশাল চাহিদা। এসব দক্ষ লোকের বেতনভাতাও অনেক বেশি। মধ্যপ্রাচ্য বা মালয়েশিয়ায় একজন শ্রমিক ন্যূনতম ১৫-২০ হাজার টাকা পান। আর উন্নত দেশে একজন শ্রমিক মাসিক বেতন পায় ন্যূনতম ৭০-৮০ হাজার থেকে শুরু ৪-৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সরকারি যেসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে সেগুলোকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করে যদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাহলে দ্রুত উন্নত বিশ্বের উপযোগী করে জনশক্তি তৈরি করা যাবে। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কর্মমুখী ব্যবস্থা থাকলে ভালো ফল আসবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি করতে জনসংখ্যাকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করে দেশ-বিদেশে কাজে লাগাতে হবে। জনসংখ্যার ওপর ভর করেই আমাদের গার্মেন্ট শিল্প দাঁড়িয়ে আছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ জনসংখ্যাকে প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে দেশ-বিদেশে জনশক্তির চাহিদা সৃষ্টি হবে এবং আয়ও বেড়ে যাবে।

কর্মস্থলে না গিয়ে ঘরে বসে আয়ের সুযোগ করে দিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি। দেশে-বিদেশে আউটসোর্সিং বাজারে প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন সবাই আয় করতে পারে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব দেশে শ্রমমূল্য কম সেসব দেশের লোকদের দিয়ে তাদের কাজ করিয়ে নেয়। বিনিময়ে কর্মীরা পেয়ে থাকে পর্যাপ্ত টাকা। বাংলাদেশি তরুণদের কেউ কেউ এ ধরনের কাজে জড়িত। তবে ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত থাকায় ও তথ্যজ্ঞান না থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজন এখনও আউটসোর্সিংয়ে আয়ের বিষয়টি অবগত নয়। আউটসোর্সিং বাজার প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে। উপমহাদেশে আউটসোর্সিংয়ের প্রায় ৪৩ ভাগ আয় করছে ভারত। বাংলাদেশ আয় করছে আউটসোর্সিংয়ের মাত্র ১ ভাগ। অথচ শ্রমমূল্য কম হওয়ায় এ বিপুল পরিমাণ টাকার বড় অংশই ঘরে তোলার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পারলে ও ঘরে ঘরে ইন্টারনেট সেবা সহজলভ্য হলে অতি অল্প সময়ে আউটসোর্সিং বাংলাদেশে গার্মেন্টস সেক্টরকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে প্রকৌশল বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, দেশের বর্ধিত জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারই হতে পারে মোক্ষম হাতিয়ার। বিশ্ববাজার ধরার পাশাপাশি দেশের বাজারেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ভাষায় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশ অনেকটা এগোলেও আশানুরূপ নয়। তথ্য-প্রযুক্তির বিশ্ববাজারে প্রবেশের জন্য ১৯৯৭ সালে একটি রূপরেখা হলেও তা বাস্তবায়নে আশানুরূপ অগ্রগতি এখনও হয়নি। তিনি আরও বলেন, বিশ্ববাজারে তথ্য-প্রযুক্তি সম্পর্কিত সেবার চাহিদা ব্যাপক। বিশ্বচাহিদার ক্ষুদ্র অংশও ধরতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে যাবে। তিনি বলেন, এশিয়ার অন্যান্য দেশ বিশেষ করে ভারত, ফিলিপাইন তথ্য-প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতির ভিত মজবুত করার পাশাপাশি প্রযুক্তি বিশ্বে নিজেদের বাড়িয়েছেন। বাংলাদেশ সেই সুযোগ কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিতে পারে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা এই বিশাল জনগোষ্ঠীর যোগ্যতা অনুযায়ী দেশে চাকরির ব্যবস্থা করতে সক্ষম নই আমরা। তাদের জন্য বিকল্প কর্মক্ষেত্র হতে পারে বিদেশের শ্রমবাজার। দেশে ও বিদেশের শ্রমবাজারে কর্তৃত্ব করতে হলে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি রফতানির কোনো বিকল্প নেই। শ্রমজীবী ও তরুণ জনগোষ্ঠীকে কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং বিদেশি ভাষা শিক্ষা দিয়ে প্রবাসে কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে বাংলাদেশ শীর্ষ রেমিট্যান্স গ্রহীতা রাষ্ট্রের তালিকায় দ্রুত ওপরে উঠে আসবে।