ফল বিশ্লেষণ : সাফল্যের পেছনে জেএসসি

গত বছর আট সাধারণ বোর্ডসহ ১০ বোর্ডে পাসের হার ছিল ৮৬.৩৭ শতাংশ, এবার তা ৮৯.০৩ শতাংশ। ২০০৭ সালে এই হার ছিল মাত্র ৫৭ শতাংশ। ১২ বছর আগে গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর প্রথম বছর ২০০১ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছিল সারা দেশে হাতে গোনা মাত্র ৭৬ জন; আর এবার তো সংখ্যাটি লাখ ছুঁইছুঁই, ৯১ হাজার ২২৬ জন। ধারাবাহিক এ সাফল্যকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিস্ময়কর হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, নতুন শিক্ষানীতি ও পাঠপদ্ধতির কারণেই এসেছে এই সাফল্য।

এবার যারা এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তারা এর আগে আরেকটি পাবলিক পরীক্ষার মুখোমুখি হয়ে উত্তীর্ণ হয়ে এসেছে। স্কুলের শিক্ষার্থীরা অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। দুই পরীক্ষা মিলে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১২ লাখ ৩৪ হাজার ২৫৬ জন শিক্ষার্থী। উত্তীর্ণের হার ছিল ৭১.৩৪ শতাংশ।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, পরীক্ষার্থীরা একটি বড় পরীক্ষায় সফল হয়ে আসার ফলেও তাদের মধ্যে পরীক্ষাভীতি কেটে গেছে। তা ছাড়া সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতিও একটা বড় ভূমিকা পালন করছে। ২১টি বিষয়ের পরীক্ষা সৃজনশীল পদ্ধতিতে হওয়ায় পাসের হার বেড়েছে। বাংলা দ্বিতীয় পত্র, ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র, গণিত ও উচ্চতর গণিত ছাড়া এবার সব বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছে সৃজনশীল প্রশ্নে। শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতাকে আয়ত্ত করার কারণে এর জয়যাত্রা অব্যাহত রয়েছে।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, এসএসসি পরীক্ষার ধারাবাহিক এ সাফল্য হচ্ছে শিক্ষানীতি ও নতুন শিক্ষা পদ্ধতির সুফল। জেএসসি-জেডিসিতে উত্তীর্ণরা এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ায় এবারের ফলাফলের সব সূচকেই গুণগত উন্নতি হয়েছে। ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়, তারা অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এবারের ফলাফলেও তার প্রভাব রয়েছে। তিনি আরো বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নোট বই পড়া, মুখস্থ করা, নকল করার চিন্তা আর নেই। শিক্ষার্থীদের এখন পুরো বই-ই পড়তে হচ্ছে। এমনভাবে পাঠদান করা হচ্ছে যাতে শিক্ষার্থীরা যেকোনো প্রশ্নের মোকাবিলা করতে পারে। মন্ত্রী জানান, সৃজনশীল পদ্ধতিতে সঠিকভাবে পাঠদানের জন্য পাঁচ লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভালো ফলাফলের নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত হয়, গণিত, ইংরেজি ও বিজ্ঞান বিষয়। এসব বিষয়ে পাস বা ফেলের ওপর নির্ভর করে পরীক্ষার ফলাফল। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় এসব বিষয়ে পাসের হার ৯০ শতাংশের ওপরে। আর এ কারণেই সার্বিক ফলাফলে পাসের হার বেড়েছে। প্রথমবারের জেএসসি পরীক্ষা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পাসের হার কমিয়ে দিয়েছিল ইংরেজি, গণিত আর বিজ্ঞান বিষয়গুলো। এর মধ্যে এই শিক্ষার্থীরা গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজিভীতি কাটিয়ে উঠতে পারার কারণেই ফল ভালো হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণিত ও ইংরেজিভীতি দূর করার জন্য আলাদা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সাড়ে চার হাজার স্কুলকে চিহ্নিত করে আলাদা বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। অতিরিক্ত ক্লাসেরও ব্যবস্থা করা হয়।

এ বছর শিক্ষাবোর্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফল করেছে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড। পাসের হার ৯৪.০৩ শতাংশ। এ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তানভীরুল আলম এবারের পরীক্ষার ফল সম্পর্কে বলেন, এবার যারা এসএসসিতে উত্তীর্ণ হয়েছে তারা তাদের মেধার পরিচয় জেএসসি পরীক্ষায় দিয়েই এসেছে। এদের মধ্যে পরীক্ষাভীতি ছিল না। নিয়মিত পড়ালেখায় তাদের মধ্যে একটি অভ্যাস তৈরি হয়েছে। এ কারণেই তারা ভালো ফল করতে পেরেছে।

সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফাজ্জল হোসেন ফলাফল সম্পর্কে বলেন, সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হওয়ার কারণে সারা দেশে অভিন্ন প্রশ্নে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও সামঞ্জস্য এসেছে। যার সুফল হচ্ছে পাসের হার ও জিপিএ ৫ সংখ্যার এই বৃদ্ধি। তা ছাড়া পাসের হারের মধ্যেও ব্যবধান কমে এসেছে। এটাকে তিনি নতুন শিক্ষানীতি ও শিক্ষাপদ্ধতির সুফল বলে অভিহিত করেন।

এবারের ফলাফলে শহরের বাইরের স্কুলগুলো ভালো করেছে। দেশ সেরা ২০টি স্কুলের মধ্যে ১১টিই হচ্ছে শহরের বাইরের স্কুল। এ প্রসঙ্গে শিক্ষাসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, শিক্ষাপদ্ধতির সুফল যে সব জায়গায় সমানভাবে পৌঁছাচ্ছে, এটা তারই প্রমাণ।

ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল মানবিক বিভাগ থেকে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৯২ হাজার ১০৯ জন। কিন্তু এই বিভাগেই পাসের হার সবচেয়ে কম, ৮৫ শতাংশ। এমনটি না হলে পাসের হার আরো বেশি হতো। বিজ্ঞান বিভাগে সবচেয়ে কম শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাস করেছে সবচেয়ে বেশি, ৯৪.৯৫ শতাংশ। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল দুই লাখ ২৬ হাজার ৩৩৭ জন। পাস করে দুই লাখ ১৪ হাজার ৯০৪ জন। ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ থেকে তিন লাখ ৬৮ হাজার ৯৭১ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাস করে তিন লাখ ৩৫ হাজার ৫১২ জন শিক্ষার্থী। পাসের হার ৯০.৯৩ শতাংশ।