জীবন বাজি রেখে মৃত্যুকূপ থেকে একে একে আড়াই হাজার জীবিত মানুষকে উদ্ধার করেছেন উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা। দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে দুর্গম ধংসস্তূপ থেকে বের করে এনেছেন চার শতাধিক লাশ। সেনাবাহিনীর সঙ্গে এই উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছে ফায়ার সার্ভিস, বিমানবাহিনী, ফায়ার কমিউনিটি ভলান্টিয়ার, রেড ক্রসসহ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এর বাইরে এককভাবে উদ্ধারকাজে যোগ দিয়েছেন শত শত মানুষ। সহায়তা করেছে জেলা প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব। মানবিক এ দুর্যোগে সব মিলিয়ে কাজ করেছেন কয়েক হাজার মানুষ। তাঁদের মধ্যে ৮০ জন আলাদাভাবে চিনিয়েছেন নিজেদেরকে।
সাভারে ভবনধসের পর ছুটে যাওয়া হাজার হাজার সাধারণ মানুষের দলেই ছিলেন তাঁরা। তবে চুপচাপ বসে থাকেননি। দিনের পর দিন বাড়িঘর, খাওয়া-দাওয়া ভুলে চালিয়ে গেছেন উদ্ধার অভিযান। হয়ে ওঠেন উদ্ধার তৎপরতার অপরিহার্য সৈনিক। আটকে পড়া শ্রমিকদের জীবন বাঁচাতে দুঃসাহসিক ভূমিকা রেখেছেন তাঁরা। ‘ভেতরে একজন মানুষকে রেখেও আমরা বের হব না’- এই ছিল তাঁদের ব্রত। দুর্ঘটনার পাঁচ দিন পর সেনা কর্মকর্তাদের অনুরোধে উদ্ধারকাজের সম্মুখভাগ থেকে সরে আসেন এই স্বেচ্ছাসেবকরা। প্রথম পর্যায়ের উদ্ধার অভিযান চলার সময় সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিকভাবে সঙ্গে রেখেছেন তাঁদের। এরপর বেছে বেছে তালিকাভুক্ত করেছেন ৮০ জনকে। নিজের তাগিদেই তাঁরা যোগ দিয়েছিলেন এই কঠিন কাজে।
অপরিসীম সাহসের সঙ্গে উদ্ধারকাজ চালানোর পর সেই ৮০ যোদ্ধার কাছে ধ্বংসস্তূপের অভিজ্ঞতা এখন দুঃস্বপ্নের মতোই মনে হচ্ছে। কালের কণ্ঠকে তাঁদের অনেকে জানিয়েছেন দুঃসাহসিক অভিযানের বেশ কিছু ঘটনার কথা। তাঁরা বলেছেন, কিছু পাওয়ার আশায় নয়, মানবিকতার টানেই ছুটে গিয়েছিলেন মৃত্যুফাঁদে। দেশবাসী তাঁদের মনে রাখলেই তাঁরা খুশি। আর কিছু চান না, কেবল চেয়েছেন সবার দোয়া।
গত রবিবার রাত থেকে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বন্ধ রেখে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে দ্বিতীয় পর্যায়ের উদ্ধারকাজ শুরু হয়। ওই রাতে শাহীনা নামে এক গার্মেন্টকর্মীকে উদ্ধারের অভিযান ব্যর্থ হওয়ার মধ্য দিয়ে এসব স্বেচ্ছাসেবী কাজ করার সুযোগ হারান। তবে রবিবার রাতে এবং সোমবার দিনভর তাঁরা রানা প্লাজার উত্তর পাশে অবস্থান নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন। যখনই ডাক আসবে আবার ঝাঁপিয়ে পড়বেন উদ্ধারকাজে। ওই দিন বিকেলে তাঁদের প্রয়োজন নেই বলে জানিয়ে দেন সেনা কর্মকর্তারা। তবে তার আগেই ৮০ জনের এই দলের প্রত্যেকের ঠিকানা ও ফোন নম্বর রেখে দেওয়া হয়। জানিয়ে রাখা হয়, প্রয়োজনে আবার সাহায্য নেওয়া হবে এসব স্বপ্রণোদিত কর্মীদের।
উদ্ধারকারী দলের অন্যতম সদস্য ময়েনউদ্দিন কালের কণ্ঠকে জানান, ভবনধসের ঘটনার পরদিন থেকে স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত সাহসীদের দিয়ে চারটি ভাগে কাজ করায় সেনাবাহিনী। রবিবার রাতে কাজ শেষ করার পর প্রাথমিকভাবে ৪৭ জনের একটি তালিকা করা হয়। পরদিন আরো ৩৩ জনের নাম সেখানে যোগ করা হয়।
সাভারের লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (বিপিএটিসি) মোটর ম্যাকানিক্স হিসেবে কাজ করেন ময়েনউদ্দিন। দুর্ঘটনার দিন ২৪ এপ্রিল দুপুর ১টা থেকে উদ্ধারকাজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ময়েনউদ্দিন বলেন, ‘আমরা চলে আসার আগে একটি অনুরোধ করেছি, এমন জাতীয় দুর্যোগের সময় সরকার ও প্রশাসন যেন আমাদের মনে করে, সহায়তা নেয়।’
হাত কাঁপেনি রবিউলের : ‘আমি জীবিত অবস্থায় অন্তত ৫০ জনকে উদ্ধার করেছি। জান বাঁচানোর জন্য নিজের হাতে সাতজনের হাত কাটছি। আমার মতো সাহসী মানুষ আর পাইবো? সেনাবাহিনীর স্যাররাও কইছে আমারে দিয়া কাম হয়। জানি না, মানুষগুলারে আর বাঁচাইতে পারবো কি না…’- সাভারের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে বুধবার কথাগুলো বলছিলেন সাভারের আড়াপাড়া এলাকার যুবক রবিউল আউয়াল খান। গত রবিবার উদ্ধারকাজ চালাতে গিয়ে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। গত কয়েক দিনের দুর্ধর্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে রবিউল বলেন, তিনি নিজে ছয় নারী ও এক পুরুষকে সার্জিক্যাল ব্লেড দিয়ে হাত-পা কেটে বের করে আনেন। গত শনিবার বিকেলে তিনি জানতে পারেন তৃতীয় তলায় ১১ জন জীবিত আটকা আছে। সেই দুর্গম এলাকায় কেউ যেতে পারছিল না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রবিউল সেখানে পৌঁছে ১২ জনকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পান। রাতে অসুস্থ অবস্থায় তিনজনকে বের করে আনেন তিনি। এরপর নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। সিএমএইচে নেওয়া হয় রবিউলকে। একটু সুস্থ হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ফিরে যান উদ্ধারকাজে। এরপর রাতে সাতজনকে হাত, পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে বের করে আনেন। উদ্ধারকারী চিকিৎসক দলের পরামর্শে এ কাজে সার্জিক্যাল ব্লেড ব্যবহার করেন তিনি। দুঃসাহসিক এক অভিযান শেষ করে ওই রাতেই রবিউল আবার হাসপাতালে রোগী হিসেবে ফিরে যান। রবিউল জানান, তিনি একটি মোবাইল ফোন অপারেটর কম্পানির কর্মী। উদ্ধারকাজ নিয়ে বলেন, ‘জীবন বাঁচানোর জন্য এতজনের হাত-পা কাটতে আমার হাত কাঁপেনি। বরং এ কাজের জন্য আমি নিজেকে গর্বিত মনে করি। আমার জীবন তো একটাই। ওরা তো অনেক মানুষ। অনেকগুলো জীবন। ওদের বাঁচাতে পারার কারণে আমি সফল।’
গন্ধ শুঁকে লাশের সন্ধান : উদ্ধারকর্মী মোহাম্মদ হেমায়েত বলেন, ‘অন্ধকারের মধ্যে গন্ধ শুইকা বুঝতে পারছি লাশ আছে। চারতলার একটা জায়গায় অনেক লাশ আছে। হাত ধইরা টান দিলে হাত বের হয়ে আসে।’ আসলাম নামে এক উদ্ধারকর্মী দাবি করেন, তিনি নিজেই ২০০ লাশ উদ্ধার করেছেন। খণ্ডিত লাশের গন্ধ তাঁকে কাজ থেকে একটুও দমাতে পারেনি। শনিবার পর্যন্ত তাঁর হাত থেকে এসব লাশ বুঝে নেন সরকারি সংস্থার কর্মীরা। মানিকগঞ্জের আসলাম সাভারের একটি ওয়ার্কশপের কর্মী। গত সোমবার রাতে বাড়িতে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আপনারা আমার জন্য দোয়া কইরেন। আর কিছু চাই না।’
উদ্ধারকর্মী মোবারক খান সাভারের শাহীবাগ এলাকার মাদ্রাসাতুল হুদা নামে একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘আমি জীবিত মানুষ বের করার চেষ্টাই করেছি বেশি। কয়েকটি লাশও উদ্ধার করেছি।’ শাহীবাগ এলাকার টাইলস ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেনও ঘটনার দিন থেকে উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলেন।
রানা প্লাজার সামনে জুপিয়ান সোয়েটার কারখানার শ্রমিক বিপ্লব হোসেন জানান, সহকর্মীদের নিয়ে তিনি প্রথম দিনই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে জীবিত ৫৭ জন উদ্ধার করে আনেন। রবিবার বিকেল পর্যন্ত ছিলেন আটকা পড়া মানুষের সন্ধানে। পাঁচ দিনে কমপক্ষে ৯০ জনকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা। সোবহান নামে এক শ্রমিককে তৃতীয় তলা থেকে জীবিত উদ্ধার ছিল তাঁদের অভিযানের শেষ সফলতা। বিপ্লব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুধু আটকা পড়া মানুষের দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়নি, উদ্ধারকালে আমাদেরও শরীরের চামড়া ছিলে যাচ্ছিল। গত শুক্রবার চারতলায় আটকে পড়া এক নারী আর্তনাদ করছিলেন- যেন তাঁর হাতটি কেটে জীবন বাঁচানো হয়। তাঁর কথামতো হাত কেটে তাঁকে সেদিন উদ্ধার করা হয়।’
উদ্ধারকর্মী সুমন, শফিকুল, জুয়েল জানান, উদ্ধারকালে অন্ধকারে হঠাৎ পা ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন কেউ কেউ। অসহায় এ মানুষগুলো উদ্ধারের আকুতি করে বলেন, ‘ভাই আমারে না নিয়া যাইবা না।’ কিন্তু সবাইকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
তবুও আক্ষেপ : স্বেচ্ছাসেবক খাজা রত্ন এখন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন। তিনি বলেন, ‘শাহীনা আমাদের কাছে বাঁচার জন্য অনেক কথা বলেছেন। তাঁকে উদ্ধার করতে না পেরে আমরা কষ্টের মধ্যে আছি।’ তিনি জানান, শাহীনা উদ্ধারকারীদের বলেছেন, তাঁর পেছনে আরো তিনজন জীবিত মানুষ আছে। তাঁদের কাউকে উদ্ধার করতে পারেননি উদ্ধারকর্মীরা।
ওই অভিযানের পেছনের অংশে থাকা স্বেচ্ছাসেবী মোবারক, জিয়াউদ্দিন, হেমায়েত উদ্দিন ও মিরাজ কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, ভবন ভাঙার জন্য ভারী যন্ত্র ব্যবহার হবে বলে একবার তাঁদের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন তাঁরা ভেতরে জীবিত তিনজন আছে এটা প্রমাণ করে আবার কাজ শুরু করেন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ক্যামেরা নিয়ে ভেতরের ফুটেজ এনে সেনা কর্মকর্তাদের দেখিয়ে রাজি করানো হয়। ওই সময় বলা হয়, ২০ মিনিটের মধ্যে উদ্ধারকাজ শেষ করতে হবে। উদ্ধারকারীরা জানান, তাঁরা দ্বিতীয় তলার অংশে আটকা পড়া শাজাহান নামেই দুই ব্যক্তির সঙ্গে রবিবার কয়েকবার কথা বলেছেন। রবিবার বিকেলে এই দুই শাজাহান এবং শাহীনাকে উদ্ধারের চেষ্টা করছিলেন তাঁরা। ওই সময়ের মধ্যে কেবল একজন শাজাহানকে বের করা গেছে।
এজাজের জীবনই এখন সংকটে : শাহীনাকে উদ্ধার করতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হন এজাজউদ্দিন কায়কোবাদ নামে এক যুবক। এজাজকে সোমবার সাভার সিএমএইচ থেকে ঢাকা সিএমএইচে স্থানান্তরিত করা হয়। সংকটাপন্ন অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার রাতে তাঁকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়েছে। এজাজের বাসা মিরপুরের মাটিকাটা এলাকায়। তাঁর বাবার নাম আবদুর রউফ। এজাজ গাজীপুরে তাঁর ভগ্নিপতি ইকবাল হোসেনের প্রতিষ্ঠান ন্যাচার প্লাস কনজুমারস অ্যান্ড ফুড লিমিটেডের ক্রয় ব্যবস্থাপক। ইকবাল হোসেন বলেন, ‘বুধবার ঘটনা শোনার পরই এজাজ সাভারে চলে যায়। সে প্রকৌশলগত কাজে পারদর্শী। তাই নিজেই ঝুঁকি নিয়েছিল। কিন্তু তাদের কারো জীবন রক্ষা হলো না। উল্টো নিজেই জীবনসংকটে পড়ল।’
প্রশংসা সবার মুখে : স্বেচ্ছাসেবকদের সম্পর্কে উদ্ধারকাজ পরিচালনাকারী দলের প্রধান, সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তাঁদের সহায়তার কারণে সেনাবাহিনীর উদ্ধার তৎপরতার প্রথম ধাপটি অত্যন্ত সফল হয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা গেছে, ২৪৩৭ জনকে।’ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসব স্বেচ্ছাসেবক দেশের সম্পদ। ফায়ার সার্ভিস সাধারণ মানুষকে দুর্যোগে কাজ করার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। উদ্ধারকারী দলে তাঁদের মতো সাহসী মানুষ প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ পেলে তাঁরা আরো ভালো কাজ করতে পারবেন।’