৪ দশক পর নিজভূমে ঘুমাবেন তাঁরা

 
 

৪ দশক পর নিজভূমে ঘুমাবেন তাঁরা আশরাফুল হক রাজীব

তুমুল যুদ্ধ যখন শেষ, দেখা গেল ময়মনসিংহ সীমান্তসংলগ্ন রণাঙ্গনে পড়ে আছেন নিথর নাসিরউদ্দিন। তাঁর চোখ দুটি খোলা, দৃষ্টি প্রিয় মাতৃভূমির সুনীল আকাশের দিকে। পাকিস্তানি সেনারা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাওয়ার পর শুধু নাসির নন, পাওয়া গেল আরো ১১ শহীদের লাশ। সহযোদ্ধারা কাঁধে করে তাঁদের বয়ে নিয়ে গেলেন ওপারে- ভারতে। মেঘালয়ের শালবনে তাঁরা সমাহিত হলেন। কোনো রকমে গোসল-জানাজা হলেও তাঁদের জন্য ছিটানো যায়নি গোলাপজল, বাজেনি বিউগলের করুণ সুর, হয়নি গানস্যালুটও। একটু বসে তাঁদের জন্য বিলাপ করারও সময় মেলেনি সহযোদ্ধাদের। কারণ কোনো রকমে কবর দিয়ে তাঁদের ফিরতে হয়েছিল রণাঙ্গনে। এটাই একাত্তরের বাস্তবতা।
শুধু নাসির নন, ভারতে চিরনিদ্রায় শুয়ে থাকা এসব বীর সেনানীর ‘শেষ ঠিকানা’ খুঁজে বের করার কঠিন এবং অনন্য কাজটি করেছেন কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক। ১০ বছর ধরে তিনি আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কবরস্থানে হন্যে হয়ে ঘুরেছেন। শেষ পর্যন্ত তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধার কবর চিহ্নিত করতে পেরেছেন তিনি। এ অভাবনীয় কাজের জন্য তাঁকে সরকার গতকাল স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেছে। পরদেশের মাটিতে শেষ ঠাঁই নেওয়া সেসব বীর এবার ফিরবেন প্রিয় মাতৃভূমিতে। চুপি চুপি নয়, তাঁরা ফিরবেন বীরের বেশে। দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জনকারী এসব শহীদকে সমাহিত করা হবে নতুন করে দেশের মাটিতে। একই সঙ্গে বর্ণিল আলোকচ্ছটায় সমাধিস্থলে এসব বীর সেনার জীবন উৎসর্গের বীরত্বগাথা উপস্থাপন করা হবে। রাষ্ট্রীয় বিশেষ দিনগুলোয় ফুলে ফুলে শোভিত হবে তাঁদের সমাধি। এর জন্য কসবায় তিন একর জমি অধিগ্রহণ করেছে সরকার।
কাজী সাজ্জাদ জহীর এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি আমার দায়িত্ববোধ থেকেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সমাহিত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর চিহ্নিত করার কাজ শুরু করি। পরে সরকার এগিয়ে এসেছে। কাজটিকে একটি ছাঁচে ফেলে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কারণ এখানে দুটি দেশ জড়িত। ভারতের একাধিক প্রদেশ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মুক্তিযোদ্ধাদের কবর চিহ্নিত করার কাজ শেষ পর্যায়ে। এখন তাঁদের দেহাবশেষ কিভাবে ফিরিয়ে আনা হবে সেই কৌশল ঠিক করা হচ্ছে। আমি যেসব কবর চিহ্নিত করেছি সেগুলো প্রকৃতই মুক্তিযোদ্ধাদের কি না, তা ভারত সরকার পরীক্ষা করেছে। এতে দেখা গেছে, আমার চিহ্নিত ৯৫ ভাগ কবরই বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের। আরো নতুন নতুন কবর চিহ্নিত হচ্ছে।’ 
সেনাবাহিনীর সাবেক এ কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত সাজ্জাদ আলী জহীর জানিয়েছেন, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের মিত্র বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন। তাঁদের অধিকাংশ ক্যাম্পই ছিল ভারতের মাটিতে। তাই মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশের লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে ক্যাম্পে। তারপর ক্যাম্পের আশপাশেই তাঁদের কবর দেওয়া হয়েছে। এখন এসব কবরেরই সন্ধান করা হচ্ছে। শিলং, গৌহাটি, ডাউকি, কুচবিহার, আমপালি, কুকিতলাসহ আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গে একশর বেশি স্পট এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের কবর আছে। ডাউকিতে ২৫১টি কবরের সন্ধান মিলেছে। শিলংয়ের মিলিটারি হসপিটালের কাছে ৫১টি কবর আছে। স্থানীয়ভাবে মপ্রেম কবরস্থান হিসেবে জায়গাটি পরিচিত। মপ্রেম আদীবাসী শব্দ। এর অর্থ পাথর। এটি পাথরবেষ্টিত কবরস্থান। শিলংয়ের বেওয়ারিশ লাশ দাফন-কাফন কমিটির প্রধান আহমদ হোসেন এবং তাঁর ভাই আফজাল হোসেন এসব কবরের তত্ত্বাবধান করছেন। পরিবারটি ১৯৭১ সাল থেকেই নিষ্ঠার সঙ্গে এ কাজটি করছে। 
সাজ্জাদ জহীর বলেন, ‘কুমিল্লার কাছাকাছি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ডের ভারতীয় অংশে ২৮২টি কবর চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০০৯ সালে জেনারেল হারুন আল রশীদের সহায়তায় এই কবরগুলো চিহ্নিত করি। এ কাজে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ও বাংলাদেশ বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) দারুণভাবে সহায়তা করেছে। মেঘালয়ের পশ্চিম গারো পর্বতের কাছে আমপালি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের চার থেকে পাঁচ শ কবর আছে। সিলেট সীমান্তের তামাবিল চেকপোস্টের কাছে নো-ম্যান্স ল্যান্ডে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সমাহিত করা হয়েছে।’ 
গত জুনে ভারতে সমাহিত মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি চিহ্নিত করতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে কমিটিতে রয়েছেন সাজ্জাদ জহীর, একই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ইনামুল কাদের খান এবং উপসচিব সাইফুল হাসান বাদল। এ কমিটি ভারতের কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এ কমিটি গঠনের কারণ হচ্ছে, কাজী সাজ্জাদ জহীর ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের কবর খোঁজার কাজটি করেছেন। তাঁর এ চেষ্টাকে সহায়তা দিতেই সরকার কমিটি করেছে। ভারত সরকারও এ কমিটিকে সহায়তা দিতে নোডাল অফিসার নিয়োগ করেছে। প্রাদেশিক সরকারের যুগ্মসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা নোডাল অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। 
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে অবস্থানরত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার যদি তাঁদের স্বজনদের দেহাবশেষ আনতে না চান, তাহলে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের মরদেহ আনা হবে। ভারতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাহিত এবং স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার কসবায় তিন একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের সহায়তায় ভারতে সমাহিত মুক্তিযোদ্ধাদের হাড়গোড় পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁদের পরিচয় শনাক্ত করা হবে। এ ব্যাপারে কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ডিএনএ টেস্টের কাজটি সহজ নয় জানিয়ে সাজ্জাদ জহীর বলেন, কার কবর সেটা চিহ্নিত করতে অবশ্যই ডিএনএ টেস্ট করতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট পরিবারের সদস্যদের সহায়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়ন সহযোগী ডানিডা ডিএনএ টেস্টে সহায়তা দিতে আগ্রহী। 
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধিনিষেধ আমলে নিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে সাজ্জাদ জহীর বলেন, ইসলামী ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের মতামত নেওয়া হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, যেখানে কবর রয়েছে, সেই কবরটার যদি অমর্যাদা না হয়, তাহলে সেটি স্থানান্তর করা যাবে। পানিতে ভেসে যাওয়ার ঝুঁকি থাকলে বা কেউ যদি কবরের পাশে গিয়ে দোয়া করতে চান এবং সেখানে বাধা দেওয়া হয় তাহলে কবর স্থানান্তর করা যাবে। এ ছাড়াও কবর স্থানান্তর করার আরো কিছু উপযুক্ত কারণ আছে। এসব কারণ আমলে নিয়েই কবর স্থানান্তর করা হবে। কিভাবে কবরগুলো চিহ্নিত করেছেন জানতে চাইলে সাজ্জাদ জহীর বলেন, ‘ভারতে গিয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় যেখানে কবর দেওয়া হয়েছে সেই জায়গাগুলো চিহ্নিত করি। পরে স্থানীয় মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার শিক্ষক যাঁরা জানাজা পড়িয়েছেন, তাঁদের খুজে বের করি। তাঁরাই বলতে পারেন সঠিক খবর। এ ছাড়া স্থানীয় পুলিশে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁরাও সহায়তা দিয়েছেন। এলাকার মুরব্বিরা তো রয়েছেনই। সেই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন, পঞ্চায়েত আমাকে সহায়তা করেছে।’ 
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে এরই মধ্যে দুই দেশের সরকারপ্রধানের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। ২০০১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশ সফর করেন তখন বিষয়টি তোলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা কমিটি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। এর আগে ২০০৬ সালের ২৫ জুন চারদলীয় জোট সরকার পাকিস্তানের করাচি থেকে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনে। ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভারত থেকে ফিরিয়ে আনে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের মরদেহ। তাদের দেহাবশেষ নতুন করে মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়। 
আজ থেকে ১০ বছর আগে সাজ্জাদ জহীর এ কাজটি শুরু করলে জাপানের নজরে আসে। পরে তাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ১১ জনের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের একটি দল তাদের একদল সৈনিকের সমাধিক্ষেত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে বলে জানা গেছে।
ভারত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কবর স্থানান্তর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শাহরিয়ার কবীর বলেন, সেখানে কবর সংরক্ষণ করা হয় না। তাই তাঁদের ফিরিয়ে এনে সমাহিত করতে পারলে সেটা জাতির জন্য অনেক বড় কাজ হবে। দেশবাসী শ্রদ্ধা জানাতে পারবে। পরিবারের সদস্যরা কবরের পাশে যেতে পারবেন। 

সম্পাদক : ইমদাদুল হক মিলন, উপদেষ্টা সম্পাদক : অমিত হাবিব, ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের পক্ষে ময়নাল হোসেন চৌধুরী কর্তৃক প্লট-৩৭১/এ, ব্লক-ডি, বসুন্ধরা, বারিধারা থেকে প্রকাশিত এবং প্লট-সি/৫২, ব্লক-কে, বসুন্ধরা, খিলক্ষেত, বাড্ডা, ঢাকা-১২২৯ থেকে মুদ্রিত।
বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ : বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, প্লট-৩৭১/এ, ব্লক-ডি, বারিধারা, ঢাকা-১২২৯। পিএবিএক্স : ০২৮৪০২৩৭২-৭৫, ফ্যাক্স : ৮৪০২৩৬৮-৯, বিজ্ঞাপন ফোন : ৮১৫৮০১২, ৮৪০২০৪৮, বিজ্ঞাপন ফ্যাক্স : ৮১৫৮৮৬২, ৮৪০২০৪৭। E-mail : info@kalerkantho.com