ব্যাংকে নগদ অর্থের উদ্বৃত্ত বাড়ছে

ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছে ব্যাংকগুলো। গ্রাহক চাহিদা থাকলেও অনেক ব্যাংকই ঋণ দিচ্ছে না। এতে ব্যাংকগুলোয় নগদ অর্থের উদ্বৃত্ত বাড়ছে। নেতিবাচক বা ঋণাত্মক অবস্থানেও রয়েছে অনেক ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধি। কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধি আবার এক অঙ্কে নেমে এসেছে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত এক ধরনের স্থবিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত ১৬ আগস্ট ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৩৭ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ৩০ আগস্ট তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা। আর ৬ সেপ্টেম্বর তা হয় ৪২ হাজার ১৯৫ কোটি ও ২৫ অক্টোবর ৪৭ হাজার কোটি টাকা। যদিও এর বড় অংশের বিনিয়োগ রয়েছে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ নওশাদ আলী চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা মেনে চলার জন্য বলা হয়েছে। তারাও সতর্ক নতুন কোনো ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে। আমাদের কড়া নজরদারি রয়েছে। এসব কারণে অতিরিক্ত তারল্য বেড়েছে। তবে এর বেশির ভাগই বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে ব্যাংকগুলো।’
বিভিন্ন ব্যাংক থেকে জানা গেছে, গত ১ নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অন্যান্য ব্যাংকের মধ্যে এবি ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৫, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ১ দশমিক ৫, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১০ দশমিক ২৯, কমার্স ব্যাংকের ৯, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৬ দশমিক ৫, ব্যাংক এশিয়ার ১০ দশমিক ৬৯, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ১০ দশমিক ২, সিটিব্যাংক এনএর ঋণাত্মক ২৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ, এইচএসবিসির ৬ দশমিক ১ শতাংশ, ব্যাংক আল-ফালাহর ঋণাত্মক ৫ দশমিক ৫, যমুনা ব্যাংকের ঋণাত্মক ১৭ দশমিক ৭৬, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (এসবিআই) ঋণাত্মক প্রায় ১৪ ও কৃষি ব্যাংকের ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর এ অবস্থা প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) ভাইস চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার বলেন, বড় অঙ্কের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করছে ব্যাংকগুলো। কুঋণ হওয়ার চেয়ে ঋণ না দেয়া ভালো— এ নীতিতে চলছে সবাই। এ ছাড়া সরকারের ঋণ গ্রহণ ও আমদানি ঋণপত্র খোলার হার কমেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমানত ও ঋণের সুদের হার কমে আসবে।
বিদেশী ব্যাংকগুলোর মধ্যে সিটিব্যাংক এনএ, ব্যাংক আল-ফালাহ, এসবিআইয়ের মতো ব্যাংকগুলো খুচরা (রিটেইল) ঋণ না দিলেও সাধারণত বড় বড় সিন্ডিকেট ঋণ দিয়ে থাকে। এইচএসবিসি সব ধরনের ব্যাংকিং করলেও তাদের ঋণের প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক নয়। একই সমস্যায় ভুগছে স্থানীয় কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক। কোনো কোনো ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধি মোটামুটি ভালো হলেও সামনের মাসগুলোয় তা কমে আসবে বলে ধারণা করছেন ব্যাংকাররা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারি গ্রাহক-ব্যাংক আস্থা নষ্ট করেছে। এটা কাটাতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। অন্যদিকে অবকাঠামো সমস্যায় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ নিতে আগ্রহী না হওয়ায় ব্যাংকে নগদ টাকা জমছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির ফলে নতুন করে ঝুঁকি নিচ্ছে না ব্যাংকগুলো। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোয় প্রচুর নগদ অর্থ জমলেও তা বিনিয়োগ হচ্ছে না। হলমার্কের ঘটনার পর থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক ও ব্যবসায়ী উভয়পক্ষই অস্বস্তিতে আছে। যারা ভালো ব্যবসায়ী, তারা ব্যাংক এড়িয়ে চলছেন। যেসব ব্যবসা সচল আছে, সেগুলোই কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে না পারলে অর্থবছর শেষে তার প্রভাব পড়বে লভ্যাংশের ওপর। সব মিলিয়ে এ অবস্থাকে ‘অস্বস্তিকর’ বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা।
এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চাইলেই ঋণ পাই। ফলে টাকার কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু আমি ঋণ নেব কেন? চাইলেও শিল্প সম্প্রসারণ করতে পারছি না। সুদের হার অত্যধিক। তারপর ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে শিল্প করলাম, কিন্তু পরিষেবা পাব কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। এখন হলমার্কের মতো ব্যবসায়ীরা বা ট্রেডার অনেকেই ব্যাংকের পেছনে ছুটছেন। আর অনেক ব্যাংক আমাকে টাকা সাধছে, ধরনা দিচ্ছে। কিন্তু টাকা নিয়ে করব কী? শিল্প গড়ে তুলতে না পারলে ঋণ শোধ করব কীভাবে?’
অন্যদিকে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের অন্যতম আমদানিকারক আবুল বশর বলেন, ‘ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। কিস্তি পরিশোধে দেরি হয়নি। এমনকি কোনো অনিয়মের অভিযোগও নেই আমাদের কোম্পানির বিরুদ্ধে। তা সত্ত্বেও কয়েকটি ব্যাংক লিমিট ও চাহিদা থাকার পরও নতুন ঋণ দিচ্ছে না। বরং কোম্পানির হিসাব থেকে ঋণ সমন্বয় করছে।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যাংক খাতের এ অবস্থা বলে দেয়, অর্থনীতি একটি বৃত্তের মধ্যে আটকে আছে।
জানা গেছে, সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতে তারল্য ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। গত ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকে অতিরিক্ত নগদ টাকা ছিল ৫ হাজার ২২৬ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ১ হাজার ৬৯১ কোটি ও জনতা ব্যাংকের ৪ হাজার ৮৫৬ কোটি। একই সময়ে বেসরকারি খাতের উত্তরা ব্যাংকের অতিরিক্ত নগদ টাকা ছিল ২ হাজার ৯৯২ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ২ হাজার ১৭৭ কোটি, ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ১৬ কোটি, প্রাইম ব্যাংকের ৩ হাজার ২১৩ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংকের ১ হাজার ৫৬১ কোটি, আল-আরাফাহ ব্যাংকের ১ হাজার ৩৪০ কোটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ২ হাজার ৭৯ কোটি ও যমুনা ব্যাংকের ১ হাজার ১৯৫ কোটি।
গত ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত হিসাবে রাষ্ট্রায়ত্ত চার (সোনালী, রূপালী, অগ্রণী ও জনতা) ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য দাঁড়ায় ১৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোয় এর পরিমাণ ২৫ হাজার ৫০০ কোটি, বিদেশী ব্যাংকে ৫ হাজার ৩০০ ও বিশেষায়িত ব্যাংকে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। ৬ সেপ্টেম্বর হিসাবে তা ছিল যথাক্রমে ১২ হাজার ৫২২ কোটি, ২৩ হাজার ৪৬১ কোটি, ৫ হাজার ১৬২ কোটি ও ১ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। ব্যাংকের ঋণ প্রদান না থাকায় কমে এসেছে ঋণ আমানত অনুপাতও। গত ১ নভেম্বর পর্যন্ত হিসাবে ঋণ আমানত অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৭৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। 
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম আমিনুর রহমান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী আমরা গত বছরের চেয়ে ১৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারব না। তা পূরণ হয়ে যাওয়ায় আমরা ঋণ দেয়া বন্ধ করেছি। অতিরিক্ত তারল্য আমরা কল মানি ও ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করছি।’