সাইকেলে চড়ে গ্রামে গ্রামে তথ্য সেবা

ক্ষমতায়িত হচ্ছেন গ্রামীণ নারীরা

আমিনা বেগম কয়েক বছর আগেও কম্পিউটারের চেহারা দেখেননি; কিন্তু এখন সৌদি আরবে কর্মরত স্বামীর সাথে স্কাইপেতে নিয়মিত কথা বলছেন। বাইসাইকেলে করে তার কাছে এ ইন্টারনেট প্রযুক্তি সেবা নিয়ে এসেছে এক নারী। কয়েক ডজন ‘ইনফো লেডিস’ (তথ্য নারীরা) এভাবেই সাইকেলে চড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামে হাজির হচ্ছেন ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে। তাদের মাধ্যমে হাজার হাজার গ্রামীণ লোক বিশেষ করে নারীরা সরকারি সেবা গ্রহণ থেকে শুরু করে প্রিয়জনের সাথে চ্যাট করছে। ১৫ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার বাংলাদেশে যেখানে মাত্র ৫০ লাখ লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করছে সেখানে এ ধরনের ঘটনা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। 

বাংলাদেশের প্রান্তিক এলাকায় ইন্টারনেট ব্যবহারের উপর এপির ফরিদ হোসেনের করা এই প্রতিবেদনটি, ইউএসএ টুডে, সিবিএস নিউজ, দ্য হিন্দু, নিউজ টাইমস, ওয়াশিংটন টাইমস, কানেকটিকাট পোস্টসহ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থা ডি. নেট ও আরো কিছু সংস্থার সহযোগিতায় ২০০৮ সালে এই ‘ইনফো লেডিস’ প্রকল্প শুরু হয়। বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের বিস্তর ব্যবহারের কারণে এ প্রকল্প সহজ হয়েছে। মূলত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কেন্দ্রীয়  ব্যাংক ও বিশ্বে কাজ করা অভিবাসী শ্রমিকদের সহযোগিতায় আগামী কয়েক বছরে প্রযুক্তিতে দক্ষ কয়েক হাজার নতুন কর্মজীবী তৈরি করাই এ প্রকল্পের লক্ষ্য।

এ প্রকল্পের আওতায় কম্পিউটার, ইন্টারনেট, প্রিন্টার ও ক্যামেরার ব্যবহার শেখানোর জন্য ডি. নেট নারীদের তিন মাস প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এসব বাইসাইকেলসহ এবং প্রযুক্তিগত যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থাও করে দিচ্ছে সংস্থাটি। ডি. নেটের নির্বাহী পরিচালক অনন্যা রায়হান এ বিষয়ে এপিকে বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় আমরা কর্মহীন নারীদের কর্ম সংস্থানের সৃষ্টি করে দিচ্ছি। একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে গ্রামীণ জনগণকে ক্ষমতায়িত করা সম্ভব হচ্ছে।

গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরা অবশ্য বিনামূল্যে এই সেবা ব্যবহার করছেন না। গাইবান্ধার বাসিন্দা আমিনা বেগমকে তার সৌদি আরবে কর্মরত স্বামীর সঙ্গে কথা স্কাইপেতে কথা বলার জন্য এক ঘণ্টায় ২০০ টাকা দিতে হয়। স্বামীর টাকা পাঠানোর খবর যেমন আমিনা দিতে পারছে তেমনি স্বামীর কথাও শুনতে পারছে। এমনকি আমিনা বেগমের বৃদ্ধ শাশুড়ীও এখন স্কাইপেতে ছেলের সঙ্গে কথা বলেন। আমিনা বেগম বলেন, আমরা মোবাইল ফোনের পরিবর্তে স্কাইপিতে কথা বলি, কারণ এজন্য স্বামীর চেহারা দেখতে পাই।

ইনফো লেডিসরা কিছু কিছু সামাজিক সেবা অর্থের মাধ্যমে দেয় আবার কিছু দেয় বিনামূল্যে। তাদের গ্রামবাসীকে সরকারি সেবার বিষয়ে জানতে সহায়তা করে। অনেক সময় কৃষকদের সার ও কীটনাশকের ব্যবহারবিধি সম্পর্কে ধারণা দেয়। তারা ১০ টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তির অনলাইন ফর্ম পূরণ করে দেয়।   

অনন্যা রায়হানের মতে, ইনফো লেডিসরা একই সাথে উদ্যোক্তা ও সেবা প্রদানকারী। রায়হান জানান, ২০০৪ সালে ‘মোবাইল লেডিস’ নামক একটি প্রকল্পের মাধ্যমে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনুস বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে নারীদের কাছে মোবাইল ফোন প্রযুক্তি পৌঁছে দিয়েছিলেন। তার এ প্রকল্প সফল হয়েছিলো। বর্তমানে বাংলাদেশে ৯ কোটি ২০ লাখ লোক মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন। সেখান থেকেই ইনফো লেডিস ধারণা মাথায় আসে তার। বর্তমানে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৯টি জেলায় প্রায় ৬০ জন ইনফো লেডিসরা কাজ করছেন। ২০১৬ সালের মধ্যে এই প্রকল্পের আওতায় ১৫ হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হবে। চলতি বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ইনফো লেডিস প্রকল্পে সুদবিহীন ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর মাসে মোট ১০ কোটি টাকার ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় দেয়া হবে।

বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃত্ প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে এই প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।

সুবিধাভোগী আমিনা বেগমের এলাকার ইনফো লেডি ২৯ বছর বয়সী সাথী আক্তার জানান, এই কাজ করে স্কুলে শিক্ষকতার চেয়ে বেশি উপার্জন করে থাকেন তিনি। ১ লাখ ২০ হাজার টাকার ঋণের কিস্তি দেয়া ও অন্যান্য খরচ মেটানোর পরও প্রতি মাসে প্রায় ১০ হাজার টাকা জমাতে পারেন তিনি। তিনি বলেন, আমরা শুধু উপার্জনই করছি না, পাশাপাশি গ্রামীণ নারীদের তথ্য দিয়ে ক্ষমতায়িত করতে পারছি। এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে আনন্দের বিষয়।

Source