সচল রয়েছে দেশের অর্থনীতির চাকা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

সমপ্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যালোচনায় দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের অবস্থান দেখানো হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, বিশ্বমন্দার বিলম্বিত প্রভাব কাটিয়ে অর্থবছরের শুরুতে এসে অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক ইতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। যদিও বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে বিভিন্ন জালিয়াতির কারণে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, তারপরেও সার্বিক অর্থনীতির চিত্র আগের তুলনায় আরো ভালো হয়েছে। জাতীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ কিছু সূচকের বর্তমান অবস্থা পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হল :

বৈদেশিক বিনিময় হার কিছুদিন আগেও বিশ্বব্যাপী মার্কিন ডলারের বিনিময় হার এবং স্বর্ণমূল্যের অস্থিতিশীলতার কারণে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে কিছুটা অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছিল। কিন্তু সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী টাকা-ডলার ভারিত গড় বিনিময় হার ১১ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে হয়েছে ৮১.৮৪ টাকা পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ে ছিল ৭৪.২৭ টাকা।

স্টক এক্সচেঞ্জ মূল্যসূচক : ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক মূল্যসূচক ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪৪৩১.৫১ ও ৮৬১১.০৫ পয়েন্টে।

কলমানি মার্কেট : রমজান ও ঈদ উপলক্ষে কিছুদিন আগেও ব্যাংকগুলোতে কিছুটা তারল্য সংকট দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে তারল্য সংকট অনেক কেটে গেছে। ফলে স্থিতিশীল পর্যায়ে আছে দেশের কলমানি মার্কেট। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ১১ সেপ্টেম্বর আন্তঃব্যাংক কলমানি মার্কেটের ভারিত গড় হার ছিল ১০.২০ শতাংশ। অথচ জুলাই মাসেও এ হার ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ।

রফতানি : ২০১১-১২ অর্থবছরে রফতানি আয় পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৫.৯৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৪২৮ কোটি ৭৬ লাখ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী জুলাই, ২০১২ মাসে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৪.২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। জুলাই ২০১২ মাসে রফতানি আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৪৩ কোটি মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী অর্থবছর ২০১১-১২ তে পঁৎৎবহঃ ধপপড়ঁহঃ নধষধহপব উদ্বৃত্তের পরিমাণ ১৭০৪.০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, পূর্ববর্তী অর্থবছরে (২০১০-১১) যার পরিমাণ ছিল ৮৮৫.০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আমদানি : সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ২০১১-১২ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ৫.৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ২০১০-১১ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় ৪১.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। জুলাই, ২০১২ মাসে ২০১১-এর জুলাই মাসের তুলনায় ঋণপত্র স্থাপনাভিত্তিক আমদানি ৯.৬৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে অন্যপক্ষে এ সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তিভিত্তিক আমদানি ১.৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আলোচ্য সময়ে খাতওয়ারী ঋণপত্র স্থাপনার তথ্য পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, মূলধন পণ্য, পেট্রোলিয়াম এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি মূল্য যথাক্রমে ২৯.৩৯ শতাংশ, ২৬.৬৮ শতাংশ ও ০.৬৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে ভোগ্যপণ্যের আমদানি মূল্য ৬১.৭২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

রাজস্ব : সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, জুলাই ২০১২ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ জুলাই ২০১১ মাসের তুলনায় ১১.৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৬ হাজার ৩৮৬.৫৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১১-১২ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ১৯.৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৮০ হাজার ৪২২.৮৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছিল।
মূল্য পরিস্থিতি : বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনা অনুযায়ী সর্বশেষ আগস্ট ২০১২ মাসে ১২ মাসের গড়ভিত্তিক ও পয়েন্ট-টু-পয়েন্টভিত্তিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১০.০৮ শতাংশ ও ৭.৯৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের আলোচ্য সময়ে এ হার ছিল যথাক্রমে ৯.৪৩ শতাংশ ও ১১.২৯ শতাংশ।

রেমিটেন্স : রেমিটেন্স প্রবাহের ধারা অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১১.৮৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৩৬ কোটি ৮৯ লাখ ডলারে দাঁড়ায়, যা ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৬.২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২১ কোটি ৭৩ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছিল। উল্লেখ্য আগস্ট, ২০১২ মাসে প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১৬ কোটি মার্কিন ডলার।

বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ : চলতি মাসের ১২ তারিখ বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের পরিমাণ প্রায় ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ে, যার পরিমাণ ছিল ১০২১৮.৯৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। খুব শিগগিরই রিজার্ভের হার ১৩ বিলিয়ন ডলার হবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করেন।

জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ : সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, জুলাই ২০১২ মাসে জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ ২০৯.১১ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। জুলাই ২০১১ মাসে যার পরিমাণ ৩১১.০৩ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০১১-১২ অর্থবছরে জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৭৯.০২ কোটি টাকা, যেখানে পূর্ববর্তী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫৬.৯০ কোটি টাকা।

মুদ্রা সরবরাহ, অর্থ ও ঋণ পরিস্থিতি : ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশের রিজার্ভ মুদ্রা ও ব্যাপক অর্থ সরবরাহ যথাক্রমে ৮.৯৯ শতাংশ ও ১৭.৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ ও বেসরকারি খাতে ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ১৯.৫৩ শতাংশ ও ১৯.৭২ শতাংশ।

শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণ ও মূলধন পরিস্থিতি : বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের মোট ঋণে শ্রেণীকৃত ঋণের অংশ জুন ২০১২ শেষে দাঁড়িয়েছে ৭.১৭ শতাংশ, যা জুন ২০১১ শেষে ছিল ৭.১৪ শতাংশ। নিট ঋণে শ্রেণীকৃত নিট ঋণের অংশ জুন ২০১২ শেষে দাঁড়িয়েছে ১.৭১ শতাংশ, যা জুন ২০১১ শেষে ছিল ১.২৯ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরের মার্চ মাসের তুলনায় শ্রেণীকৃত ঋণের হার বেড়েছে।

কৃষি ও শিল্প ঋণ : বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৪ হাজার ১৩০.০ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ১৩ হাজার ৮০০.০ কোটি টাকার তুলনায় প্রায় ২.৩৯ শতাংশ বেশি। উল্লেখ্য, ২০১১-১২ অর্থবছরে কৃষিঋণ বিতরণ লক্ষ্যমাত্রার ৯৫.১৬ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, জুলাই, ২০১২ মাসে কৃষিঋণ বিতরণ ও আদায়ের পরিমাণ যথাক্রমে ৭৩৭.৩২ কোটি এবং ৩২৭২.৮৪ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরের কৃষিঋণ বিতরণ ও আদায়ের পরিমাণ হয়েছে যথাক্রমে ১৩ হাজার ৯৪৫.৮১ কোটি এবং ১২ হাজার ৩৫৯.০০ কোটি টাকা পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১২ হাজার ১৮৪.৩২ কোটি এবং ১১ হাজার ৪৫০.০৭ কোটি টাকা।

২০১১-১২ অর্থবছরে শিল্পখাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণ ৯.৬৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরের চতুর্থ ত্রৈমাসিকে শিল্পখাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণ ও আদায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১০ হাজার ২১৮.২১ কোটি ও ৭ হাজার ৮৮৮.৮৩ কোটি টাকা, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ে ছিল যথাক্রমে ৭ হাজার ৬৭৫.৪৯ কোটি ও ৫ হাজার ৭১০.৯১ কোটি টাকা।