বছরের শুরু থেকেই তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো তেমন ঋণ দিতে পারছে না। মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিও রয়েছে। শেয়ারবাজারেও মন্দা চলছে। মুদ্রাবাজারের নগদ টাকার টানাটানির খবর প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হয়েছে।
কিন্তু তার পরও এসব তথ্য যেন ভুল প্রমাণ করে ২০১২ সালের প্রথম ষাণ্মাসিক (জানুয়ারি-জুন) হিসাবে ব্যাংকগুলো আকর্ষণীয় পরিচালন মুনাফা করেছে। হাতেগোনা কয়েকটি বাদে বাকি ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফাও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি।
এর কারণ, মূল ব্যাংকিংয়ের বাইরের আয়ের খাত। এর মধ্যে আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স (প্রবাসী-আয়) খাতে যেমন আয় আছে, তেমনি দেশের অভ্যন্তরে অর্থ স্থানান্তর, বিভিন্ন ধরনের গ্যারান্টি ও সেবা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কমিশন ও ফি আয় ইত্যাদি রয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সভাপতি ও এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ নূরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ঠিক যে, তারল্য চাপ থাকায় মূল ব্যাংকিংয়ে আয় কম হয়েছে। তবে অন্যান্য সেবামূলক কাজে ফি, কমিশন আদায় বেড়েছে।’
তবে ব্যাংকিং বিশ্লেষকদের মতে, এই যে বিপুল অঙ্কের পরিচালন মুনাফা এবং পরবর্তী সময়ে তা থেকে যে নিট মুনাফা হবে, তার মধ্যেও একধরনের গোঁজামিল বা ব্যাংকিংয়ের ভাষায় ‘অ্যাকাউন্টিং জাগলিং’ অনেক ব্যাংকের ক্ষেত্রেই থাকতে পারে। আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করে হিসাব তৈরি করা হলে মুনাফা অনেক কমে আসবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের শ্রেণীকরণে সম্প্রতি যে দুটি নির্দেশনা দিয়েছে, তার বাস্তবায়ন করা হলে এই মুনাফা কমে আসবে। তিনি বলেন, ‘এগুলো আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ নয়, এটা আন্তর্জাতিকভাবে সর্বোত্তম চর্চা এবং ব্যাসেল কমিটির সুপারিশ। ঋণমান আন্তর্জাতিক মানে করা হলে মুনাফাও কমে আসবে।’ তাঁর মতে, মুনাফা বেশি দেখাতে হয়তো কোনো কোনো ব্যাংক এগুলো অনুসরণ করতে চাইছে না। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন করা হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ভাবমূর্তি বিশ্বের কাছে বাড়বে। তবে কিছু সময় দেওয়াও যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
জানা গেছে, এ বছর আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স খাতে ব্যাংকের আয় বেশি বেড়েছে। এর কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য-পরিস্থিতি। আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে টাকার অঙ্কে পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের কমিশন আয় এ সময় বেড়েছে।
বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নিজস্ব উদ্যোগে সংগ্রহ করা সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, বরাবরের মতো অর্ধবার্ষিকীর হিসাবে পরিচালন মুনাফার পরিমাণের দিক থেকে সর্বাধিক আয় হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের। ছয় মাসে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৯৪৫ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৬৫০ কোটি টাকা।
তবে ইসলামী ব্যাংকের আমানত ও বিনিয়োগের (ঋণ) পদ্ধতি ভিন্ন। উপরন্তু ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ বেসরকারি একক কোনো ব্যাংকের চেয়ে অনেক বেশি।
পরিচালন মুনাফার দিক থেকে ইসলামী ব্যাংকের পরই রয়েছে প্রাইম ব্যাংক। প্রাইম ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার পরিমাণ হয়েছে ৪৬৬ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪০৫ কোটি টাকা।
তারপর রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। যদিও ব্যাংকটির এবারের মুনাফা গত বছরের প্রথম ষাণ্মাসিকের চেয়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকা কম হয়েছে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে পরিচালন মুনাফার পরিমাণ হয়েছে ৩৯১ কোটি টাকা। আগের বছর প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা হয়েছিল ৪৯০ কোটি টাকা।
প্রকৃত মুনাফা নয়: বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে পরিচালন মুনাফা প্রকাশের ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ রয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো পরিচালন মুনাফা প্রকাশ করতে পারে না। এই বিধিনিষেধ এসেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) থেকে। এসইসি মূল্য সংবেদনশীল বিবেচনায় এই তথ্য প্রকাশ করতে দিতে চায় না। আর বাংলাদেশ ব্যাংকও তাতে সম্মতি দিয়েছে।
তবে শেয়ারবাজারে যাঁরা প্রতিনিয়ত কেনাবেচা করেন এবং যাঁদের হাতে কোনো ব্যাংকের শেয়ার রয়েছে, তাঁরা ব্যক্তি যোগাযোগের মাধ্যমেই এ তথ্য আগেভাগেই পেয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রে সংবাদপত্রে তথ্য প্রকাশিত হলে সব বিনিয়োগকারীই একই তথ্য পেতে পারেন।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী পরিচালন মুনাফা প্রকাশ একটি সাধারণ নিয়মের বিষয়। তবে নিট মুনাফাই ব্যাংকের প্রকৃত আয়। বছর শেষে পরিচালন মুনাফা থেকে ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ এবং কর (৪২ দশমিক ৫ শতাংশ) বাদ দিয়ে নিট মুনাফার হিসাব হয়। উপরন্তু, প্রাথমিকভাবে পাওয়া এই তথ্য-উপাত্ত কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। কেননা, কোনো কোনো ব্যাংকের জুন হিসাব আপাত শেষ হলেও এর অনেক ক্ষেত্রে হিসাব চূড়ান্ত করতে আরও কয়েক দিন লেগে যেতে পারে। ফলে মুনাফার পরিমাণ শেষ পর্যন্ত কমে বা বেড়ে যেতে পারে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীকে অপেক্ষা করতে হয় নিট বা প্রকৃত মুনাফার হিসাব পাওয়া পর্যন্ত।
ব্যাংকের অর্ধবার্ষিক পরিচালন মুনাফা
(৩০ জুন; কোটি টাকায়)
ব্যাংকের নাম ২০১১ ২০১২
ইসলামী ব্যাংক ৬৫০ ৯৪৫
ন্যাশনাল ব্যাংক ৪৯০ ৩৯১
প্রাইম ব্যাংক ৪০৫ ৪৬৬
সাউথইস্ট ৩২৫ ২৫৭
পূবালী ২৮০ ৩৬৫
ইউসিবিএল ২৮০ ২৯৩
ইস্টার্ন ব্যাংক ২৫০ ২৮০
ডাচ্-বাংলা ২৪৫ ৩০১
ব্র্যাক ব্যাংক ২৩০ ২৭০
ব্যাংক এশিয়া ২১৫ ২৫৪
এনসিসিবিএল ২০১ ২০৪
এবি ব্যাংক ২০০ ১৯০
ঢাকা ব্যাংক ১৯৫ ২১৫
আইএফআইসি ১৮৫ ১৯০
ওয়ান ব্যাংক ১৮০ ১৩০
সিটি ব্যাংক ১৮০ ১৮০
আল আরাফাহ ১৭৭ ২৮৫
উত্তরা ১৭০ ১৩৫
ব্যাংকের নাম ২০১১ ২০১২
মার্কেন্টাইল ১৫৮ ১৯৫
শাহজালাল ১৫৬ ২৪২
যমুনা ব্যাংক ১৫০ ১৫৬
এসআইবিএল ১৩৫ ১৭৩
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ১৩৩ ১৯২
ট্রাস্ট ব্যাংক ১০৬ ১৩০
এক্সিম ব্যাংক ১০২ ২৩২
ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ৭৮ ৮০
প্রিমিয়ার ব্যাংক ১১১ ১০০
মিউচ্যুয়াল ৬৫ ৭০
আইসিবি ইসলামী … (১)
কমার্স ব্যাংক … ২০.৫০
বেসিক ১৩৬ ১৪০
বিডিবিএল ৩২.৫০ ৫০
রূপালী ১২৫ ১৭৫
অগ্রণী ৫৬২ ৬০৩
জনতা ৬১৫ ৭০০
সোনালী ৬৩৩ ৫১১